নীরা ম্যাডামের মত একজন কাউকে এনে কি পাশে বসাব? তার সঙ্গে গল্প করব। না থাক। বরং তার চিঠিটার একটা জবাব মনে মনে লিখে ফেলি। এই চিঠি তিনি পড়বেন না। তাতে কী? অন্তত আমি নিজেতো জানব তাঁর চিঠির একটা জবাব আমার কাছে আছে। সম্বােধন কী হবে? নীরা ম্যাডাম লিখব?–কি ভাবী? সুজনেষু? সুহৃদয়েষু? কোনটাইতো মানাচ্ছে না। যদি শুধু নীরা লেখা যেত তাহলে মানাতো। সেটা সম্ভব না। উনি অনেক বড় মানুষ–আমি কে? আমি কেউ না।
আপনার চিঠিটি আজ রাতে পড়েছি। যে কোনো চিঠি আমি দুবার তিনবার করে পড়ি। আপনারটা একবারই পড়েছি। এত সুন্দর চিঠি কিন্তু দ্বিতীয়বার পড়তে ইচ্ছে করল না। আপনি চিঠিটা নষ্ট করে ফেলতে বলেছেন— আমি নষ্ট করে ফেলেছি। ছিড়ে কুচিকুচি করে চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছি। তারপরেও চিঠিটা পুরোপুরি নষ্ট হয় নি। আপনার মাথায় রয়ে গেছে। আমার মাথায়ও রয়ে গেছে। যেদিন আমরা দুজন পৃথিবীতে থাকব না শুধুমাত্র সেদিনই চিঠিটা নষ্ট হবে। চিঠিতে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও আপনি জানতে চাচ্ছিলেন— কেন আমি উনাকে এত পছন্দ করলাম। বা আমার মত অন্যরা কেন করছে। আপনি এই প্রশ্নের জবাব জানেন না দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি। আপনার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের এই প্রশ্নের জবাব পেতে এত দেরি হল কেন? কী করে আপনি ভাবলেন–উনার ছেলে ভুলানো পিঁপড়ের ধাঁধা জাতীয় কথায় বিভ্রান্ত হয়ে পাগলের মত সবাই উনার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। কিংবা উনার দুঃখময় শৈশবের গল্প শুনে আমাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে প্রবল করুণা। করুণা থেকে জন্ম নিচ্ছে প্রেম। আপনি এমনও ধারণা করছেন যেন উনি নানান ধরনের কৌশল করে করে আমাকে বা লাবণ্যকে বা আমাদের মত কাউকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করছেন? আপনি নিজে মেয়ে — আপনারতো জানা উচিত মেয়েরা সবার আগে যা ধরতে পারে তা হল পুরুষদের কৌশল। পুরুষদের ছ্যাবলামী ও সহ্য করা যায় কিন্তু কৌশল না।
প্রবল আবেগ নিয়ে উনার কাছে ছুটে যাওয়ার কারণটি এখন আমি ব্যাখ্যা করি? আমার মা একবার টবে পুঁই শাকের একটা চারা পুতলেন। চারাটায় যেন ঠিকমত রোদের আলো পড়ে সে জন্যে মা টটাকে বারান্দার মাঝামাঝি এনে রাখলেন। তারপর আমি একদিন কী কারণে যেন বারান্দায় গিয়েছি হঠাৎ দেখি পুইশাকটা বড় হয়েছে। ডাল বের করে দিয়েছে। কিন্তু কোন কিছু ধরতে পারছে না। সে যেন তার অনেকগুলি হাত বের করে দিয়েছে, কিন্তু সেই হাত দিয়ে সে কাউকে ছুঁতে পারছে না। কী ভয়ংকর অসহায় যে লাগছে গাছটাকে।
ডিরেক্টর সাহেব অবিকল এ রকম একটা লতানো গাছ। যে গাছটা অনেক বড় হয়ে গেছে কিন্তু শক্ত করে ধরার মত কিছু পাচ্ছে না–সে আতঙ্কে অস্থির। সে কি এই জীবনে ধরার মত কিছু পাবে না?
এ ধরনের মানুষের পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছার নামই ভালবাসা। আমার ভালবাসার শুরুটা সেখানেই, সম্ভবত আপনার বোন লাবণ্যের ব্যাপারেও এ রকম হয়েছে।
মানুষটার পাশে আগ্রহ নিয়ে দাঁড়ানোর পর অবাক হয়ে দেখলাম তার শঙি ও ক্ষমতা। সৌন্দর্য দেখার ক্ষমতা। সৌন্দর্য ব্যাখা করার ক্ষমতা। সৃষ্টিশীল মানুষের যে ব্যাপারটা থাকে। প্রকৃতি হয়ত খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই ক্ষমতা দিয়ে দেয়। যারা এই ক্ষমতাটা পায় তারাও খুব স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। ক্ষমতার মাত্রা সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকে না। কিন্তু আমার মত মানুষ যারা সৃষ্টিশীল না তারা অভিভূত হয়। অভিভূত হয়ে ভাবে সাধারণ একজন মানুষের এত ক্ষমতা? আপনি নিজেও কি অভিভূত হন নি? তাঁকে দেখামাত্রই কি আপনার সমস্ত চেতনা কেঁপে ওঠে নি?
কোন মেয়ে যদি প্রেমে পড়ে তাহলে তার চোখে প্রেমিকের সৎ গুণ গুলিই পড়ে। ত্রুটি গুলি চোখে পড়ে না। আপনি লিখেছেন— প্রেমিক যখন নাক ঝেড়ে হাত সিকনিতে ভর্তি করে ফেলে — তখন মনে হয়—আহা কী সুন্দর করেই না নাক ঝাড়ছে।
আমি মেয়েটা একটু বোধ হয় আলাদা। আমি শুধু তার ত্রুটিগুলি বের করতে চেষ্টা করেছি। তার কারণও আছে, তার ত্রুটিগুলি চোখে পড়লে তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধতা কমতে থাকবে। আমি ধাক্কা খাব। ফিরে যেতে পারব নিজের জগতে। সেলিম ভাইকে তিনি ছবিতে নিলেন। সুপারস্টার ফরহাদ সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। তখন আমি মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম যেন তিনি সেলিম ভাইকে বাদ দিয়ে দেন। যেন আমি তার এই ব্যাপারে মস্ত একটা আঘাত পাই। যেন আমি তার কাছ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারি।
সে রকম হয় নি। উল্টোটাই হয়েছে। ফরহাদ সাহেবের মত নামী দামী অভিনেতাকে তিনি পাত্তাই দেন নি। কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের ত্রুটি গুলিই গুণ হিসেবে দেখা দেয়। উনি তেমন একজন। মানুষের মস্ত বড় ত্রুটি তার অহংকার। কিন্তু উনার অহংকারইতো উনার গুণ। আপনি জানেন না তার ত্রুটিগুলি দেখে আমি যতই দূরে সরতে গিয়েছি ততই তার গছে আসার জন্যে ব্যাকুল হয়েছি। ততবারই মনে হয়েছে এইসব ত্রুটি আমার নেই কেন?
আপনার মত একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে কী করে ধারণা করল মেয়ে ভুলানোর জন্যে তিনি তার মজার মজার গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেন?
আপনি কি দেখেন নি এই একই গল্প তিনি কত আগ্রহের সঙ্গে মওলানা সাহেবের সঙ্গে করছেন, বা ইউনিটের একটা ছেলের সঙ্গে করছেন।
তাঁর সম্পর্কে আমি এমন অনেক কিছুই বলতে পারব যা আপনি দীর্ঘদিন বিবাহিত জীবন যাপন করেও লক্ষ্য করেন নি।