তিথির মা বললেন, চুপ করতো মা। এত সব বলার দরকার কী!
তিথি বলল, আমার বলতে ইচ্ছে করছে। তুমি দয়া করে ইন্টারফেয়ার করবে না। ভাত যা খাবার খেয়েছি। আর খাব না। আমার মুখ ধুইয়ে চলে যাও। কাল ঢাকা চলে যাচ্ছি–রুমালীর সঙ্গে আর দেখা হবে না। আজ তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করব।
তিথির মা বললেন, গল্প সকালে করলে হবে না?
না সকালে করলে হবে না। এখনি করতে হবে। প্লীজ তোমরা দুজন এখন যাও।
আমি ভাত খাচ্ছি। তিথি আমার সামনে বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প হে খুব ভাল লাগছে তিথির গল্প শুনতে।
পাপিয়া ম্যাডামের সঙ্গে আমার লেগে গেল। একটা সিকোয়েন্স নেয়া হবে। দিলু আর নিশাত বসে আছে। দিলু বলবে–আপা তুমি কথা বলার সময় আমার নকে তাকাচ্ছ না কেন?
নিশাত বলবে, কথা বলার সময় তোর দিকে তাকাতে হবে কেন?
আমার সঙ্গে কথা বললে–আমার দিকে তাকিয়ে বলতে হবে!
কেন তুই এত বিরক্ত করিস দিলু।
এই কথাটা তুমি আমার দিকে তাকিয়ে বল।
নিশাত তখন বিরক্ত হয়ে উঠে যাবে। এই দৃশ্যটা হার সময় বামেলা হল। পাপিয়া ম্যাডাম অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছেন আমি হাত দিয়ে তার মুখ ধরে আমার দিকে ফিরিয়ে বললাম–আমার সঙ্গে কথা বললে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে হবে?
পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, তিথি শোন আমার গায়ে হাত দিও না। আমাকে টাচ না করে ডায়ালগ বল।
আমি বললাম, সেটা ভাল হবে না।
পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, ভাল হোক বা না হোক। তুমি আমার গায়ে হাত দেবে না!
আমি বললাম–গায়ে হাত দেব না কেন? আপনার কি কোন ছোঁয়াছে অসুখ আছে যে গায়ে হাত দিলে আমার সেই অসুখ হয়ে যাবে?
পাপিয়া ম্যাডাম রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন— এ রকম বেয়াদবী কার কাছ থেকে শিখেছ? আমি বললাম, আমি কারো কাছ থেকে কিছু শিখি না। আমি যা করি নিজে নিজে করি।
তিথিকণা খুব হাসতে লাগল।
আমি বললাম, তোমাদের এই ঝগড়া ঝাটির সময় ডিরেক্টর সাহেব কি করলেন? চুপ করে রইলেন?
ঝগড়া যখন শুরু হল তখন উনি ছিলেন না। হঠাৎ উনার শরীর খারাপ করল। তিনি শট ডিভিশন তার এসিসটেন্টকে বুঝিয়ে দিয়ে তার ঘরে চলে গেলেন। আমি যখন বললাম আমি অভিনয় করব না। তখন সোহরাব চাচা ডিরেক্টর সাহেবকে আনতে গেলেন। উনি এলেন না। বলে পাঠালেন, শুটিং প্যাক আপ।
উনার সঙ্গে পরে তোমার দেখা হয় নি?
দেখা হয়েছে। শুটিং স্পট থেকে এসে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। উনি দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে বসেছিলেন। আমি যখন বললাম, আংকেল আমি অভিনয় করব না। কাল ঢাকা চলে যাচ্ছি। উনি বললেন, আচ্ছা। আমি বললাম, আংকেল আপনি রাগ করছেন নাতো? উনি বললেন, আমি তোমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করব। যদি ধাঁধার জবাব দিতে পার তাহরে রাগ করব না। তিনটা পিঁপড়া নিয়ে একটা ধাঁধা।
তুমি জবাব দিতে পেরেছ?
হ্যাঁ পেরেছি।
কাল সকালে তুমি চলে যাচ্ছ?
আমি একা না। সবাই চলে যাচ্ছে।
সে কী?
সোহরাব চাচা বলেছেন— শুটিং শিডিউল নতুন করে করা হবে। এখন সব কাজ বন্ধ। বাকি যা কাজ শীতের সময় করা হবে। তারা যে জেনারেটার নিয়ে এসেছিল সেটাও ঠিক মত কাজ করছে না। আমার কী মনে হয় জান? আমার মনে হয় এই ছবিটা আর হবে না। না হলেই ভাল।
না হলে ভাল কেন? গল্পটা বাজে। দিলু মরে গেল। দিলু মরবে কেন? মরার মত কী হয়েছে? দুঃখ কষ্ট পেলেই মরে যেতে হবে?
তিথি।
বল।
তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
দূর থেকে দেখেছতো এই জন্যে পছন্দ হয়েছে। কাছ থেকে দেখলে পছন্দ হত না। দূর থেকে যে জিনিস যত সুন্দর কাছ থেকে সেই জিনিস তত অসুন্দর।
তাই বুঝি?
অবশ্যই তাই। দূর থেকে চাঁদ কত সুন্দর। কাছে গেলে পাথরের পাহাড়— এবড়ো থেবড়ো, খানা, খন্দ, গর্ত।
জাহেদা বলেছিল রাতে ঝড় হবে। সোমেশ্বরী নদীতে বান ডাকবে। হাতি ডোবা বান! জাহেদার কোন কথাই ঠিক হয় না। এই কথাটা কি মিলে যাবে? আকাশে কোন তারা দেখা যাচ্ছে না। মেঘ জমেছে। বিজলী চমকাচ্ছে। বিজলী চমকালেই বজের শব্দ শোনা উচিত। বজের শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। ঝড় দেখার জন্যে অপেক্ষা করছি। বারান্দায় বেতের চেয়ারে পা তুলে বেশ আরাম করে বসে আছি। ঝিঝি ডাকছে না। বড় ধরনের বৃষ্টি বা ঝড়ের আগে আগে ঝিঝি পোকারা চুপ করে যায়।
ক্যাম্প নীরব হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেও উঠোনে কয়েকজন লাইটবয় ঝগড়া করছিল। এখন তারা নেই। জোনাকি আছে। প্রচুর পরিমাণে আছে। জোনাকি ধরার কোন জাল থাকলে এক খেপে অনেক জোনাকি ধরে ফেলা যেত। একটা লম্বা সুতায় মৌমাছির মোম মাখিয়ে জোনাকিগুলি বসিয়ে দিলেইজোনাকির মালা।
মাকে নিয়ে আমি এখন আর দুঃশ্চিন্তা করছি না। বাবা চলে এসেছেন দুঃশ্চিন্তা যা করার তিনিই করবেন। জোনাকি পোকার একটা মালা বানিয়ে বাবাকে দিয়ে এলে চমৎকার হত। দেয়া গেল না। একদিকে ভালই হয়েছে। মালা বানান হলে হয়ত দেখা যেত বাস্তবের মালা কল্পনার মালার মত সুন্দর হয় নি।
অস্পষ্ট ভাবে বৃষ্টির ফোঁটা কি পড়তে শুরু করেছে? বোধ হয় না। পাহাড়ি বৃষ্টি ঝম করে চলে আসে। ধীরে সুস্থে আসে না। যত বৃষ্টি নামুক, ঝড় আসুক আমি এই জায়গা থেকে নড়ব না। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হলেও খবরদারীর জন্যে আজ মা আসবেন না। টেনে হিচড়ে ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করবেন না। আজকের রাতটা পুরোপুরি আমার। রাতটা আমি গল্প করে করে কাটাব। কার সঙ্গে গল্প করব? দিলুর যেমন কল্পনার বান্ধবী আছে এমন কোন কল্পনার বান্ধবীকে নিয়ে আসব। ঝুম বৃষ্টি নামলে দুজনে মিলে ভিজব। সোমেশ্বরী নদীতে সত্যি যদি হাতি ডোবা বান ডাকে তাহলে তাকে নিয়ে নদী দেখতে যাব। মানুষ এক কোথাও যেতে পারে না। যখন কেউ থাকে না তখন কল্পনার একজনকে পাশে থাকতে হয়। কল্পনার বন্ধু থাকা খুব চমৎকার ব্যাপার। তাকে নিজের মত করে তৈরি করা যায়। পছন্দ না হলে ঢেলে সাজানো যায়। তাকে রূপ দেয়া যায়। তার কাছ থেকে রূপ কেড়ে নেয়া যায়।