মওলানা সাহেব!
জ্বি আম্মাজী।
আপনি কি আমার মার জন্যে একটু দোয়া করবেন?
এটাতো আম্মাজী আপনাকে বলতে হবে না। উনি হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকে খতমে ইউনুস পড়তেছি। খুব শক্ত দোয়া ইউনুস নবী এই দোয়া পড়ে মাছের পেট থেকে নাজাত পেয়েছিলেন।
ক্যাম্প কেমন নিঃস্বাণ। লোকজন নেই। রাত এমন কিছু হয় নি অথচ মনে হচ্ছে সবাই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু ডিরেক্টর সাহেবের ঘরে আলো জ্বলছে। আমি নিজের ঘরে চলে গেলাম। ঘরে ঢুকে বড় ধরনের চমক খেলাম। বাবা খাটে বসে আছেন। তাঁর পাশে কালো রঙের হ্যান্ড ব্যাগ।
টেবিলে কলা, আনারস। তাকে খুবই বয়স্ক দেখাচ্ছে। মাথার চুল প্রায় সবই পড়ে গেছে। শেষবার যখন দেখেছি তখনো তার মাথায় অনেক চুল ছিল। মনে হচ্ছে অল্পদিনেই তাঁর বয়স বেড়ে গেছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে হাসলেন। আমার মনে হল তিনি অকূল সমুদ্রে পড়েছিলেন। আমাকে দেখে খানিকটা ভরসা পেলেন। আমার ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলি—বাবা তুমি আজ আসায় আমি তোমার সব অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু সে রকম কিছুই করতে পারলাম না। শুধু বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আমি খবর পেয়েই রওনা হয়েছি, তারপর গাড়ি নষ্ট, ফেরী নাই— বিরাট ঝামেলা। এসে শুনি তোর মা হাসপাতালে…।
তুমি যে সত্যি এসেছ বিশ্বাস হচ্ছে না।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, তোরা বিপদে পড়বি আমি আসব না?
মা তোমাকে দেখে কী যে খুশি হবে।
বাবা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর চোখ কেমন যেন ভেজা ভেজা মনে হচ্ছে। কেঁদে ফেলবেন নাতো? আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে বললাম, ওরা কেমন আছে বাবা? আমার দুই ভাই বোন?
বাবা নিচু ভঙ্গিতে বললেন, ভাল।
ওদের নাম আমি জানি না। ওদের নাম কী?
বাবা বিব্রত গলায় বললেন, মেয়েটার নাম রূপা আর ছেলের নাম তার মা রেখেছে সাকিব।
নিজের ছেলেমেয়েদের নাম বলছেন এতে এত বিব্রত হবার কী আছে? আমি বললাম, রূপা নাম তুমি রেখেছ?
হুঁ।
ওরা কি জানে রুমালী নামে তাদের একটা বোন আছে?
জানবে না কেন। জানে।
তুমি কি রূপাকে স্কুলে দিয়ে আসো, নিয়ে আসো?
তার মা দিয়ে আসে। আমি নিয়ে আসি।
ফেরার পথে তুমি কি তোমার মেয়েকে আইসক্রীম কিনে খাওয়াও? ততে যেমন খাওয়াতে?
বাবা জবাব দিলেন না। বাবা খুবই অস্বস্থি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। বাবার কি এখন উচিত না তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়া? না-কি মেয়ে অচেনা হয়ে গেছে? অচেনা মেয়েকে আদর করতে সংকোচ লাগছে?
তোমার শরীরটা এত খারাপ হয়েছে কেন বাবা। বুড়ো হয়ে গেছ।
বয়স হয়েছেতোরে মা।
কেন বয়স হচ্ছে?
বাবা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। হাসি থামিয়ে বিপ্ন গলায় বললেন, তোর মার শরীর কি বেশি খারাপ?
হ্যাঁ। তবে তুমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই মার শরীর ভাল হয়ে যাবে।
আমি এখনই যাচ্ছি। রাতে হাসপাতালেই থাকব।
মিশনারী হাসপাতাল, তোমাকে থাকতে দেবে না।
অসুবিধা নেই। বারান্দায় বসে থাকব। না-কি বারান্দাতেও বসতে দেবে
বারান্দায় বসতে দেবে। বাবা শোন বিয়ের পর পর তুমি মাকে চমকে দেয়ার জন্যে অনেক উদ্ভট কাণ্ডকারখানা করতে। এ রকম কোন উদ্ভট কিছু কি করতে পারবে?
বাবা অবাক হয়ে বললেন—কী করতে বলছিস?
জোনাকি পোকার একটা মালা মার গলায় পরিয়ে দেবে?
জোনাকি পোকার মালা পাব কোথায়?
আমি জোগাড় করে দেব। বাবা তুমিতো জান না— তুমি মাকে একটা কম্বল কিনে দিয়েছিলে–সেই কম্বলটা মা চৈত্র মাসের গরমেও গায়ে দিয়ে রাখে। তুমিতো হাসপাতালে যাচ্ছ মায়ের পায়ের কাছে কম্বলটা দেখবে।
এইসব কথা কেন বলছিস!
আমার মনটা খুব খারাপতো। এই জন্যে বলছি। যখন আমার মন খারাপ হয় তখন ইচ্ছে করে আশে পাশের সবার মন খারাপ করে দেই।
বাবা পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, তুই একটু কাছে আয়তো মা। তোর মাথায় হাত বুলিয়ে তোকে একটু আদর করি।
আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছি। আমি কাদছি না কিন্তু বাবা খুব কাঁদছেন।
আমি বাবার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি যেন তিনি বয়স্ক কোন মানুষ নন। অল্প বয়েসী শিশু! খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়ে কাঁদছেন।
বাবা মওলানা সাহেবকে নিয়ে মাকে দেখতে গেছেন। আমি গোসল করে কাপড় বদলে ডাইনিং হলে খেতে গিয়েছি। ডাইনিং হলে তিথি বসে আছে। একপাশে তিথি, এক পাশে তার মা এবং এক পাশে বাবা। তিথি মুখের সামনে একটা বই ধরে আছে। তিথির মা ভাত মাখিয়ে তার মুখে তুলে দিচ্ছেন। আমাকে দেখে তিনি লজ্জা পেলেন। এত বড় মেয়েকে মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিতে হচ্ছে এই জন্যেই হয়ত লজ্জা। আমার কাছে দৃশ্যটা খুব সুন্দর লাগল। তিথি মুখের উপর থেকে বই নামিয়ে বলল, তুমি কোথায় ছিলে? বিকেল থেকে তোমাকে খুঁজছি। কেউ বলতে পারছে না তুমি কোথায়। এদিকে তোমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। মেয়েকে খোঁজা হচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি দেখি আমার চেয়েও অদ্ভুত।
খুঁজছিলে কেন?
বলেছিলাম না তোমাকে ছবি দেখাব? রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছবি। ছবি খুঁজে পাই নি। মনে হচ্ছে আনা হয় নি। সোহরাব আংকেলের কাছ থেকে তোমার ঠিকানা নিয়েছি। ঢাকায় পৌঁছেই তোমাকে পাঠিয়ে দেব।
আচ্ছা।
তুমি কি শুনেছ যে আমি অভিনয় করছি না। ঢাকা চলে যাচ্ছি।
শুনেছি।
কী জন্যে অভিনয় করব না, সেটা শুনেছ?