মার মৃত্যুর পর আমার কী হবে? জীবন যাত্রায় তেমন কোন পরিবর্তন কী হবে? মার সঙ্গে আগে যে ঘরে থাকতাম পরেও নিশ্চয়ই সেই ঘরেই থাকব। বজ্রপাতের শব্দে মার বুকের কাছে লুকানোর সুযোগ হবে না। আশ্বিন মাসে শেষ রাতের দিকে যখন শীত পড়বে তখন ঘুম ঘুম চোখে মাকে বলব না–মা গায়ে কথা দিয়ে দাও।
মৃত্যু শোক ভোলা যায় না বলে একটা ভুল কথা প্রচলিত আছে। সবচে সহজে যে শোক ভোলা যায় তার নাম মৃত্যু শোক সবচে তীব্র শোক হচ্ছে— জীবিত মানুষ হারিয়ে যাবার শোক। হারিয়ে যাওয়া মানুষটি যতদিন জীবিত থাকে ততদিন এই শোক ভোলা যায় না। বাবা যদি মাকে ছেড়ে না গিয়ে মারা যেতেন মা বাবাকে ভুলে যেতেন এক বছরের মাথায়। তার ভালবাসার কম্বল উইপোকায় কেটে ফেলত। বাবা বেঁচে আছেন কিন্তু হারিয়ে গেছেন বলেই মার এই তীব্র কষ্ট।
পাশাপাশি থেকে ওতো একজন মানুষ হারিয়ে যেতে পারে। মঈন সাহেব তাঁর স্ত্রীর পাশেই বাস করছেন কিন্তু হারিয়ে গেছেন। নীরা ম্যাডামের শোক এবং যন্ত্রণার এইটাই কারণ। নীরা ম্যাডাম কি এই তথ্য জানেন?
আম্মাজী আমরা এসে পড়েছি–এইটা মিশনারী হাসপাতাল।
হাসপাতাল কোথায়, ছিমছাম ছোট্ট লাল ইটের বাড়ি। সামনে কী সুন্দর বাগান। বাগানের ঠিক মাঝখানে মাদার মেরীর পাথরের মূর্তি। মেরীর কোলে শিশু জেসাস খাইস্ট। হাসপাতালের কাছাকাছি এলেই ফিনাইলের গন্ধ পাওয়া যায়— আমি পাচ্ছি ফুলের ঘ্রাণ। বেলী ফুলের ঝাড় থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে। কী আশ্চর্য!
মিশনারীদের হাসপাতালতো আম্মাজী–বড় সুন্দর। এই হাসপাতালে মৃত্যু হলেও আরাম। একটা ভাল জায়গায় মৃত্যু হল। হাসপাতাল যিনি চালান—ফাদার পিয়ারে উনি বিশিষ্ট ভদ্রলোক বিশিষ্ট ডাক্তার। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। বড়দিনের দিন আমাকে এক ঝুড়ি ফল পাঠায়েছেন। একটা নতুন স্যুয়েটার পাঠায়েছেন। নীল রঙ। আসল ভেড়ার লোমের স্যুয়েটার। মাঘ মাসের শীতে এই স্যুয়েটার পরলে গরমে গায়ে ঘামাচি হয়ে যায়। স্যুয়েটারটা চুরি হয়ে গেছে। থাকলে দেখতাম।
আম্মাকে সবাই পছন্দ করে কেন?
এটাতো আম্মাজী বলতে পারব না। এটা আল্লাহপাকের একটা মহিমা!
বাগান পার হয়ে হাসপাতালের সামনে দাঁড়ালাম। আমাদের পায়ের শব্দে যিনি বের হয়ে এলেন তিনিই ফাদার পিয়ারে! তালগাছের মত লম্বা একজন মানুষ। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তারপরেও মনে হচ্ছে শক্ত শরীর। খেটে খাওয়া মানুষদের মত পেশী বহুল হাত। পরনে বাঙ্গালীদের মত লুঙ্গী এবং লুঙ্গীর উপর হাতকাটা পাঞ্জাবি। সুন্দর বাংলা বলেন। মাঝে মধ্যে দুএকটা নিতান্ত গ্রাম্য শব্দ তার বাংলায় ঢুকে পড়ে। তাতে তার বাংলা ভাষা আরো সুন্দর হয়ে কানে বাজে। যেমন আমার মা সম্পর্কে বললেন–তোমার মা ভাল আছে। শ্বাস কষ্ট ছিল এখন নাই। এখন শান্তিমত ঘুমাইচ্ছে। ঘুমাইচ্ছে শব্দটা কী সুন্দর করেই না কানে বাজল।
খুকী তুমি মাকে দেখে চলে যাও। আমাদের এখানে রুগীর সঙ্গে থাকার নিয়ম নাই। মা ঘুমাইচ্ছে–ডোন্ট ওয়েক হার আপ। ঘুমের অষুধ দিয়েছি।
আমি মার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। মা হাত পা এলিয়ে পড়ে আছেন। তাঁর নাকে অক্সিজেনের নল। হাতে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। খুব ধীর লয়ে তার বুক ওঠা নামা করছে। একজন নার্স মার পাশেই টুল পেতে বসে আছেন। ফাদার পিয়ারে বলেছিলেন মা শান্তিমত ঘুমুচ্ছেন। এই কি শান্তিমত ঘুমের নমুনা? দেখেতো মনে হচ্ছে মা মৃত্যুর হাত ধরে শুয়ে আছেন। আমি নার্সকে বললাম, সিস্টার আমি কি মায়ের গায়ে হাত রেখে পাশে বসতে পারি? সিস্টার ঘাড় কাত করলেন।
মার হাতে হাত রাখতেই তিনি ঘুমের মধ্যেই হাত সরিয়ে নিলেন। তার পরপরই চোখ মেললেন। আমি বললাম, কেমন আছ মা?
মা হাসলেন। এবং আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
শরীরটা কি খুব খারাপ লাগছে?
সন্ধ্যার সময় খুব খারাপ লাগছিল! এখন লাগছে না।
তোমার অবস্থা দেখে আমার খুব ভয় লাগছে।
ভয়ের কিছু নেই আমি মরব না। আমি মরলে তোকে কে দেখবে?
আমি মার হাত আমার কোলে রাখলাম! নার্স বললেন, আপনি চলে যান। তনি এখানে থাকলেই আপনার মা কথা বলতে থাকবেন। ঘুম হবে না। তার ঘুম দরকার। ফাদার জানতে পারলে খুব রাগ করবেন। উনি ভয়ংকর রাগী।
তুমি মার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললাম, মা যাই।
মা চোখ বন্ধ রেখেই বললেন–তোর বাবা বোধ হয় রাতেই আসবে। যদি আসে হাসপাতালে পাঠানোর দরকার নাই। এই হাসপাতালে বাইরের কাউকে থাকতে দেয় না।
মা আমার উপর তোমার রাগটা কি একটু কমেছে?
কোন রাগ নেই।
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ সত্যি।
মা আমি যাই?
আচ্ছা। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করিস।
আচ্ছা।
তোর বাবা যদি আসে তাহলে তার খাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখিস। খাওয়ার সময় সামনে থাকিস। কেউ সামনে না থাকলে সে খেতে পারে না।
মা তুমি নিশ্চিত থাক। বাবা যদি আসে আমি অবশ্যই তাকে সামনে বসিয়ে খাওয়াব।
মার জন্যে আমার কষ্ট হচ্ছে। বাবা যে আসবে না, এই সহজ সত্যটা তিনি বুঝতে পারছেন না। যে চলে যায় সে ফিরে আসার জন্যে যায় না। তার জন্যে ভালবাসার স্বর্ণ সিংহাসন সাজিয়ে রাখলেও লাভ হবে না। আর যে আসে সে সিংহাসনের জন্যে অপেক্ষা করে না।
আমি মওলানা সাহেবকে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরছি। মওলানা সাহেবের টর্চ ঠিক হয়েছে। আলো দিচ্ছে। এর আগে কি তিনি মিথ্যা মিথ্যি টর্চ নষ্ট করে রেখেছিলেন? যাতে আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বড় রাস্তায় নিয়ে আসতে পারেন। সেখান থেকে মিশনারী হাসপাতালে।