সে তার এই অসম্পূর্ণতা জন্মসূত্রে নিয়ে এসেছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কিছুই করার নেই।
আমি তাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলি নি। আমি তাকে বাস করতে দিয়েছি। সম্ভবত একজন অসুস্থ মানুষের সঙ্গে থেকে থেকে আমি নিজেও মানসিক ভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েছি। তার কষ্ট অবশ্যই অসহনীয়, আমার নিজের কষ্টও কিন্তু অসহনীয়। সে নিজে যেমন পশুর মত কাদে আমি নিজেও পশুর মত কাদি। মাঝে মাঝে গভীর রাতে সে ছাদে চলে যায়। রেলিং এর উপর উঠে বসে— আমি পেছনে পেছনে গিয়ে বলি, কী করছ? সে বলে, নীচে লাফিয়ে পড়ব। সাহস সঞ্চয় করছি। আমি বলি— প্লীজ ডু দ্যাট। তোমার জন্যে ভাল হবে। আমাকে মুক্তি দেবার জন্যে নয়। নিজেকে মুক্তি দেবার জন্যেই এই কাজটা তোমার করা দরকার।
রুমালী! একজন মানুষ কোন পর্যায়ে এ ধরনের কথা বলতে পারে?
তোমাদের চণ্ডিগড়ে জাহেদা নামের একটা মেয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করে। সে বলেছে–চণ্ডিগড়ে শুটিং হবে না। একটা মানুষ মারা যাবে। শোনামাত্রই আমার মনে হয়েছে— আচ্ছা এই মানুষটা কি মঈন হতে পারে না? ভয়ংকর একটা খেলা কি শেষ হবে না?
প্রকৃতি অসুন্দর পছন্দ করে না। অপূর্ণতা পছন্দ করে না। তারপরেও সে অসুন্দর এবং অপূর্ণতা তৈরি করে তাদের নিয়ে বিচিত্র খেলা খেলে। কেন খেলে বলতো?
আমার যা লেখার আমি লিখলাম। তোমার সঙ্গে কি আবারো আমার দেখা হবে? দেখা না হওয়াই ভাল। আর যদি দেখা হয়েও যায়— আমি ভাব করব তোমাকে চিনতে পারি নি। তুমি তাতে রাগ করো না। আরেকটা ছোট্ট অনুরোধ। চিঠিটা তুমি নষ্ট করে ফেলো।
–নীরা
মওলানা সাহেব আগে আগে যাচ্ছেন
মওলানা সাহেব আগে আগে যাচ্ছেন। আমি তার পেছনে। মওলানা সাহেবের হাতের টর্চে কী যেন সমস্যা হয়েছে— কিছুতেই জ্বলছে না। আমরা পথ চলছি অন্ধকারে। মাঝে মাঝে মওলানা সাহেব থামছেন–হাতের টর্চ ঝাকাঝাকি করছেন। কোন লাভ হচ্ছে না।
আম্মাজী!
জ্বি।
নক্ষত্রের আলোয় নদীপথে যাওয়া যায় কিন্তু স্থলপথে যাওয়া যায় না। টর্চটা নষ্ট হয়ে বিপদে পড়লাম। চলেন বড় রাস্তা দিয়ে যাই। একটু ঘোরা হবে। উপায় কী।
চলুন যাই।
আমরা বড় রাস্তায় উঠলাম। আমার হাঁটতে ভাল লাগছে। লক্ষ লক্ষ ঝিঝি ডাকছে। বাতাসে মাটির এবং কাঠ পোড়ানো ধোয়ার গন্ধ। পোড়া কাঠের গন্ধ কোত্থেকে আসছে? হাঁটার সময় মানুষ না-কি খুব ভাল চিন্তা করতে পারে। আমি কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। মাথা পুরোপুরি খালি হয়ে আছে। মোসাদ্দেক স্যার বলতেন, খুকীরা মন যখন খুব অস্থির হবে তখন মনে মনে গান করবে। মন শান্ত হবে, মন শান্ত করার এর চেয়ে ভাল অষুধ নাই। মন শান্ত করার এটা হল কোরামিন ইনজেকশন! আশ্চর্য কোন গানের কথা, কোন গানের সুর আমার মনে আসছে না।
আম্মাজী।
জ্বি মওলানা সাহেব।
মনটা কি অত্যধিক খারাপ হয়েছে?
নাতো মন খারাপ হবে কেন?
নীরা ম্যাডাম বলেছিলেন, চিঠি পড়ার পর রুমালীর মনটা হয়ত খুব খারাপ হবে। মওলানা তুমি তার দিকে লক্ষ্য রেখো। ম্যাডাম আমাকে অত্যধিক স্নেহ করেন। আমাকে তুমি করে বলেন। আম্মাজী মনটা কি বেশি খারাপ?
আমার মন খারাপ না।
হাঁটতে কষ্ট লাগছে?
হাঁটতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না। হাঁটতে ভাল লাগছে।
শুক্লা পক্ষ হলে হেঁটে মজা পেতেন। কৃষ্ণ পক্ষ শুরু হয়েছেতো হেঁটে মজা নাই। আম্মাজী একটা টেম্পো নিয়ে নেই।
এসেইতো পড়েছি টেম্পো নিতে হবে কেন?
মওলানা সাহেব প্রায় অস্পষ্ট গলায় বললেন, মিশনারী হাসপাতাল হয়ে যাই। মানে ব্যাপার হয়েছে কী আপনার মাতার শরীরটা সামান্য খারাপ করেছে। ডাক্তার বললেন হাসপাতালে থাকাই ভাল। তেমন কিছু অবশ্য না। হাসপাতালে না নিলেও চলত। বিদেশ জায়গা। হাসপাতালটা ভাল। মিশনারীরা হাসপাতাল, স্কুল এইসব ভাল করে।
আমি থমকে দাড়িয়ে গেলাম। মওলানা এইসব কী বলছেন? হাসপাতালে নেবার মত কী ঘটল!
মাকে হাসপাতালে কখন নেয়া হয়েছে?
বিকালে। তাঁর শরীরটা হঠাৎ খারাপ করল–নিঃশ্বাস নিতে পারেন না। হাসপাতালে আবার অক্সিজেনের ব্যবস্থা আছে। বিসমিল্লাহ বলে নলটা নাকে ঢুকায়ে দিলেই হয়।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, মাকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে এমন অবস্থা আর খবরটা আপনি এতক্ষণে দিলেন?
আম্মাজী আপনিতো ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুম থেকে ডেকে তুলে দুঃসংবাদ দিতে নাই। নিষেধ আছে। ঘুম ভাঙ্গারও ঘন্টা খানিক পরে দুঃসংবাদ দিতে হয়।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মওলানা সাহেব বার বার দুঃসংবাদ দুঃসংবাদ করছেন কেন? মা কি মারা গেছেন? সুস্থ সবল মানুষ চোখের পলকে ধড়ফড় করে মারা যায়। মা কোন সুস্থ মানুষ না।
মার শরীর এখন কেমন? ঠিক করে বলুনতো?
আম্মাজী উনি ভাল আছেন। ডাক্তার ঘুমের অষুধ দিয়েছেন। আমি যখন আসি তখন দেখে এসেছি শান্তিমত ঘুমাচ্ছেন। যে কোন অসুখে ঘুম অষুধের মত কাজ করে। অস্থির হবার মত কিছু হয় নাই! অস্থিরত। আল্লাহপাক নিজেও পছন্দ করেন না। কোরআন মজিদে এই জন্যে বলা হয়েছে— হে মানব সন্তান তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া।
আমার কোন তাড়াহুড়া নেই। আমি অস্থির না! আমি স্থির। আমি সব সময়ই এ রকম : মার মৃত্যু সংবাদ পেলেও হয়ত স্থিরই থাকতাম। ইউনিটের লেকজন বলত মেয়েটা মানুষ না পাথর? প্রকৃতি কাউকে পাথর বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠায় হাজারো দুঃখ কষ্টেও তাদের কিছু হয় না। আবার কাউকে কাউকে বরফ বানিয়ে পাঠায়––সামান্য উত্তাপে বরফ গলে পানি।