মঈন ভাইকে আমার দুলাভাই ডাকা উচিত কেন জানি ডাকতে পারি না। দুলাভাই মানেই কিছু ফাজলামি, কিছু রসিকতা। দুলাভাই মানেই আশে পাশে শালিকারা ঘুর ঘুর করছে। না এটা আমার ভাল লাগে না।
আজ সকাল থেকেই ভেবে রেখেছি মঈন ভাইকে ভড়কে দেব। কী ভাবে কাজটা করব ভেবে পাচ্ছি না। আপার সঙ্গে উনার বোধ হয় মন কষাকষি হয়েছে। উনি আলাদা ঘরে শুচ্ছেন। আমি তার মন ভাল করার প্ল্যান করছি। শুরুতে ভড়কে দিয়ে তারপর মন ভাল করে দেব। প্ল্যানটা হচ্ছে বিকট একটা মুখোশ পরে গভীর রাতে উনার জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াব। ভয় দেখিয়ে আক্কেল গুড়ুম করে দেব।
শেষ পর্যন্ত সেই প্ল্যান মত কাজ করা হয় নি। গভীর রাতে মুখোশ পরে জানালার পাশে না দাঁড়িয়ে আমি দরজায় টোকা দিলাম। উনি দরজা খুলে দিয়ে একটুও না চমকে বললেন–লাবণ্য এসো। তোমার সঙ্গে গল্প করি। সকাল থেকে মাথা ধরে আছে। গল্প করলে মাথা ধরাটা কমবে। আর শোন মুখ থেকে মুখোশটা খোল।
আমি মুখোশ খুললাম। উনি বললেন, আলো চোখে লাগছে। আলো নিভিয়ে দিলে তোমার অসুবিধা হবে?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, কোন অসুবিধা হবে না। আপনি বাতি নিভিয়ে দিন। মঈন ভাই বাতি নিভিয়ে দিলেন। আমার কাছে মনে হল এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী মেয়ে কোন দিন জন্মায় নি, ভবিষ্যতেও জন্মাবে না।
লাবণ্য আমাকে যদি ব্যাপারটা বলতো–তার সমস্যা সমাধান করা আমার পক্ষে কোন ব্যাপারই ছিল না। আমার প্রধান ত্রুটি, লাবণ্যকে চোখের সামনে দেখেও তার সমস্যা সম্পর্কে কোন রকম আঁচ করতে পারি নি।
লাবণ্যের ছায়া আমি পুরোপুরি তোমার উপর দেখছি। আমার আত্মা কেঁপে উঠেছে।
রুমালী, ভালবাসা ব্যাপারটা কি তুমি জান? আমার ধারণা তুমি এই ব্যাপারটা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ভেবেছ? তুমি কি কিছু বের করতে পেরেছ? পেরেছ বলে আমি মনে করি না। অনেক গুণীজন এই ব্যাপার নিয়ে ভেবেছেন। হিসেব নিকেষ করেছেন—— থিওরী বের করেছেন, হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছেন। ফলাফল শূন্য। কেউ কেউ বলেছেন ভালবাসার বাস মনে। মন যেহেতু আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ভালবাসাও তাই। বৈজ্ঞানিকদের কোন যন্ত্রে ভালবাসাকে ধরা ছোঁয়া যাবে না।
একদল বললেন— মন আবার কী? মস্তিষ্কই মন। মানুষের যাবতীয় আবেগের একমাত্র নিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়— কাজেই ভালবাসাও ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়। ব্রেইনের টেম্পোরাল লোবে ভালবাসা বাস করে। টেম্পোরাল লোবে অসংখ্য নিওরোনের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রিক ইম্পালসের বিশেষ ধরনের আদান প্রদানই ভালবাসা।
আরেকদল বললেন, কিছুই হয় নি। মানুষের আবেগ, ভয়, ভীতি সব কিছুর মূল নিয়ন্ত্রক পিটুইটারী গ্লান্ড। একটা মেয়ে যখন একটি ছেলের প্রেমে পড়ে তখন ছেলেটিকে দেখা মাত্র পিটুইটারী গ্লান্ড থেকে বিশেষ এক ধরনের এনজাইম বের হয়। সেই এনজাইমের কারণে ছেলেটি তখন যা করে তাই ভাল লাগে। তা দেখেই হৃদয়ে দোলা লাগে। ছেলেটি যদি ফেং শব্দ করে হাতের মধ্যে নাক ঝেড়ে সিকনিতে হাত ভর্তি করে ফেলে তখনও মনে হয়— আহারে কী সুন্দর করেই না নাক ঝাড়ছে। পৃথিবীতে তার মত সুন্দর করে কেউ নাক ঝাড়তে পারে না।
ভালবাসার সর্বশেষ থিওরীটি তোমাকে বলি। সর্বশেষ থিওরীতে বিজ্ঞানীরা বলছেন— প্রকৃতির প্রধান ইচ্ছা তাঁর সৃষ্ঠ জীবজগৎ যেন টিকে থাকে। জীব জগতের কোন বিশেষ ধারা যেন বিলুপ্ত না হয়। জীব জগতের একটা প্রধান ধারা হচ্ছে হোমোসেপিয়ানস মানব জাতি। মানবজাতিকে টিকে থাকতে হলে তাদের সন্তান হতে হবে, এবং উৎকৃষ্ট সন্তান হতে হবে। সন্তান হবার জন্যে মানব-মানবীকে খুব কাছাকাছি আসতে হবে। কাজেই তাদের ভেতর একের জন্যে অন্যের একটা প্রবল শারীরিক আকর্ষণ তৈরি করতে হবে। সেই শারীরিক আকর্ষণের একটা রূপ হচ্ছে ভালবাসা। সেই ভালবাসার তীব্রতারও হের ফের হয়। প্রকৃতি যখন দেখে দুটি বিশেষ মানব-মানবীর মিলনে উৎকৃষ্ট সন্তান তৈরির সম্ভাবনা তখন তাদের ভালবাসাকে অতি তীব্র করে দেয়। যেন তারা একে অন্যকে ছেড়ে যেতে না পারে। কোন বাধাই তাদের কাছে তখন বাধা বলে মনে হয় না। ছেলেরা রূপবতী মেয়েদের প্রেমে পড়ে কারণ প্রকৃতি চায় পরবর্তী প্রজন্ম যেন সুন্দর হয়। গুণী মানুষদের প্রেমে মেয়েরা যুগে যুগে পাগল হয়েছে। কারণ প্রকৃতির সেই পুরানো খেলা, প্রকৃতি চাচ্ছে পুরুষদের গুণ যেন পরবর্তী প্রজন্মে ডি এন এর মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। প্রকৃতি প্রাণপণে চাচ্ছে মানব সম্প্রদায়ের গুণগুলি যেন নষ্ট না হয়ে যায় যেন প্রবাহিত হতে হতে এক সময় পূর্ণ বিকশিত হয়। তৈরি হয় একটা অসাধারণ মানব সম্প্রদায়।
হাইপোথিসিস হিসেবে খুব আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে না-কি? যত আকর্ষণীয়ই মনে হোক আমার নিজের ধারণা হাইপোথিসিস ঠিক নয়। আমি মঈন নামের মানুষটির প্রতি প্রবল ভাবেই আকর্ষিত হয়ে প্রায় ঘোরের মধ্যেই তাকে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের পরপরই আমার নিজের জগৎ ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। কারণ মঈন একজন অসম্পূর্ণ মানুষ। আমি কী বলার চেস্টা করছি তুমি বুঝতে পারছ? এন্টেনা নামের আমাদের একটি মেয়ে আছে। সে আমাদের ভালবাসার ফসল নয়। তাকে দত্তক নেয়া হয়েছে।
পশু কাঁদতে পারে না, হাসতেও পারে না। তারপরেও তীব্র যন্ত্রণায় পশু মাঝে মাঝে গোঁ গোঁ শব্দ করে। পশুর যন্ত্রণার এই প্রকাশ একবার যদি তুমি দেখ–তোমার মাথায় তা সারাজীবনের মত গেঁথে যাবে। আমি প্রায়ই পশুর কান্নার এই দৃশ্য দেখি। মঈন গভীর রাতে অবিকল পশুর মতই কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে সে আমাকে কী বলে জান? সে বলে–প্লীজ ডোন্ট গ্রো মি অন দ্যা স্ট্রীট। আমাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেল না। আমি তোমাকে মুক্তি দেব। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ব বা ঘুমের অষুধ খাব। আমাকে অল্প কিছু দিন সম্মান নিয়ে বাঁচতে দাও।