রুমালী, আমার চিঠি খুব সম্ভব খানিকটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে–আমি প্রসঙ্গ ছেড়ে বাইরে চলে এসেছি। ভয় নেই আবারো প্রসঙ্গে ফিরে যাব। চিঠির এলোমেলো ভাব ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবে— কারণ চিঠিটা লিখতে গিয়ে প্রবল মানসিক চাপ অনুভব করছি।
মঈনের দুর্বলতার কথা তোমার কাছে কিছু কিছু বলেছি। তার চরিত্রের সবল অংশের কথা বলা হয় নি। আমি নিজেও কিন্তু জানি না। একজন দুর্বল মানুষ আশেপাশের সবাইকে মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারে না। সে কিন্তু পারছে। কী করে পারছে আমার তা জানা নেই। এক সময় জানতে চেষ্টা করেছি— এখন চেষ্টা করি না। ধরে নিয়েছি এটি ব্যাখ্যাতীত কোন প্রাকৃতিক কারণে ঘটছে। এই মানুষটির প্রতি তোমার প্রবল আকর্ষণের কারণ তুমি নিজে কি ব্যাখ্যা করতে পারবে? পারবে না। মঈনের কাছে যে থাকে তার মনের Rational অংশ কাজ করে না। মনে করা যাক তুমি তার পাশে গিয়ে বসলে। সে তোমার দিকে তাকিয়ে বলল, তারপর রুমালী তোমার কী খবর? তাতেই তোমার পৃথিবী দুলে উঠবে! তোমার কাছে মনে হবে এই মানুষটির মুখ থেকে এই অপূর্ব বাক্যটি শোনার জন্যে তুমি জন্ম জন্ম ধরে অপেক্ষা করছিলে।
তোমার কি মনে আছে—
আমি তোমাকে বলেছিলাম তাকে প্রথম দিন দেখেই আমার মনে প্রবল ঘোর তৈরি হয়েছিল, মনে হয়েছিল, এই মানুষটিকে আমার দরকার। মঈন নামের মানুষটি অতি সহজেই অন্যের ভেতর স্বপ্ন তৈরি করে দিতে পারে। সে তার নিজের স্বপ্নে অন্যদের টেনেও নিতে পারে। স্বপ্নহীন মানুষদের জন্য এটা অনেক বড় ব্যাপার। তারা স্বপ্ন খুঁজে বেড়ায়। প্রথমবার তাকে দেখেই আমি বাবাকে হতভম্ব করে দিয়ে বলেছিলাম, এই মানুষটিকে আমি বিয়ে করতে চাই! ছেলে সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে গিয়ে বাবা হতভম্ব সে মানুষ হয়েছে এতিমখানায় পূর্ব পরিচয় বলতে তার তেমন কিছু নেই। আমি তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাই নি–রবীন্দ্রনাথের ঐ বিখ্যাত গান–ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে। কিংবা, আমি সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়। ভাল কথা এই গান দুটি কি তুমি গাইতে পার?
এখন তোমাকে লাবণ্যের কথা বলি।
আমার যখন বিয়ে হয় আমার ছোটবোন লাবণ্য তখন দেশের বাইরে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করছে— ছুটি পায় নি বলে আসতে পারে নি। চিঠিতে আমাকে সাহস এবং উৎসাহ দিয়েছে। চমৎকার সব চিঠি। লাবণ্য আমার মত নয়— সে সুন্দর চিঠি লিখতে পারে। তার চিঠি পড়লে মনে হয় সে সামনে বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প করছে। তার গানের গলাও অপূর্ব। এই দিক দিয়ে তোমার সঙ্গে তার কিছুটা মিল আছে। সেও তোমার মতই চাপা স্বভাবের। গরমের ছুটিতে সে দেশে এল। মঈনের সঙ্গে তার প্রথম দেখা। মঈন তাকে বলল, তারপর লাবণ্য তুমি কেমন আছ? এই বাক্যটিতেই লাবণ্য অভিভূত হল বলে আমার ধারণা। তার চিন্তা চেতনার জগৎটা ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। চাপা স্বভাবের মেয়ে বলে কাউকে সে তা বুঝতে দিল না। নিজেকে প্রবল ভাবে আড়াল করে রাখল। মঈনের সঙ্গে সে একা কখনো কথা বলে নি। আমরা দুজন যখন গল্প করতাম তখনই সে উপস্থিত হয়ে হাসিমুখে বলত–আমি কি তোমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি? তোমাদের খানিকক্ষণ বিরক্ত করতে পারি?
তার ছুটি শেষ হয়ে গেল, কিন্তু সে ফিরে যেতে চাইল না। সে বলল, শান্তিনিকেতন তার ভাল লাগছে না। তারপরেও সে গেল। দিন দশেক থেকে হুট করে ফিরে এল। তার দিকে তখন তাকানো যায় না। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে। মাথার চুল উঠে উঠে যাচ্ছে। আমি তাকে বলাম, তোর কী হয়েছে? সে বলল, বুঝতে পারছি না কী হয়েছে। ব্লাড ক্যানসার ফ্যানসার হয়েছে মনে হয়। চিকিৎসা করাতে এসেছি। শরীরের সব রক্ত ফেলে দিয়ে আমি নতুন রক্ত নেব। কোন পবিত্র মানুষের রক্ত। তোমার সন্ধানে কোন পবিত্র মানুষ আছে?
তোর সমস্যা কী?
আমার সমস্যা—রাতে ঘুম হয় না। এমন কোন ঘুমের অষুধ নেই, খাই নি।
কোন লাভ হয় নি।
দিনে ঘুম হয়?
দিনে হয় তবে খুব সামান্য। আপা তুমি কোন ভাল ডাক্তার দেখিয়ে আমাকে শান্তিমত ঘুম পাড়াবার ব্যবস্থা কর। এ রকম আর কিছু দিন চললে আমি মরে যাব।
তাকে ডাক্তার দেখান হল। ডাক্তাররা কোন রোগ ধরতে পারলেন না। তার শরীর আরো খারাপ করল। পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। জীবনের শয্যাশায়ী অংশটা হয়ত তার ভাল কেটেছে কারণ এই সময় মঈন তাকে বই পড়ে পড়ে শুনাতো। নিজের লেখা চিত্রনাট্য শুনাত।
এখন তুমি যে ছবিটা করছ সেই ছবির চিত্রনাট্য তখনি করা। চিত্রনাট্যটা লাবণ্যের খুব পছন্দ ছিল। লাবণ্য বলতে আমি অভিনয়ের কিছু জানি না, কিন্তু আমি দিলুর ভুমিকায় অভিনয় করব। আপনি কিন্তু আর কাউকে দিলু হিসেবে নিতে পারবেন না। আমি করব দিলু আর আপা করবে নিশাত। আসুন আমরা রিহার্সেল করি। আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন কী করে অভিনয় করতে হয়।
তার শরীর একটু সুস্থ হল। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল শান্তিনিকেতনে ফিরে যাবার জন্যে। আমি এবং বাবা দুজনই চেষ্টা করলাম তাকে আটকে রাখতে। সে থাকবে না। তাকে না-কি যেতেই হবে। সে চলে গেল। সাত দিনের মাথায় আবার ফিরে এল।
সে মারা যায় ছাদ থেকে পড়ে। পুলিশের কাছে আমরা সে রকমই বলেছি। ঘুম হত না বলে সে ছাদে হাটত। ছাদের রেলিং-এ পা তুলে বসে থাকত। খুব সম্ভব সেখান থেকেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
ব্যাপার তা ছিল না। সে খুব সুস্থ মাথায় ছাদ থেকে লাফ দেয়। যে তীব্র আবেগ সে মঈনের জন্যে জমা করে রেখেছিল— সেই আবেগ সে কখনো প্রকাশ করে নি। আমাকে কিছু বুঝতে দেয় নি। তার মৃত্যুর পর তার ডাইরি পড়ে আমি সব জানতে পারি। ডাইরির একটি অংশ আমি এত অসংখ্যবার পড়েছি যে মুখস্থ হয়ে আছে। আমি স্মৃতি থেকে আবারো লিখছি। দেখবে এখানেও তোমার সঙ্গে লাবণ্যের খানিকটা মিল আছে—