ধলামিয়া আসছে। ছোট ছোট পা ফেলে কী অদ্ভুত ভাবেই না আসছে। আমার চোখ ভর্তি পানি। চোখের পানিতে পাখিটা ঝাপসা দেখছি।
জাহেদা বলল, ভইনডি কাইন্দেন না। আফনের কান্দনে ধলামিয়ার লাভ-লোসকান কিছুই নাই। কাইন্দা কী হইব? ভইনডি আফনের মনে হয় শইলডা খারাপ। বালিশে মাথা দিয়া শুইয়া থাকেন।
আমি বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছি। ধলামিয়া আবারো উঠোনে চলে গেছে। ঝা ঝা দুপুর। বাড়ির পেছনের কাশবনে বাতাস লেগে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। জাহেদা আমার মাথার কাছেই কাঁথা নিয়ে বসেছে। কোন নকশি কাঁথা তৈরি হচ্ছে না। কাব্যময় কোন দৃশ্য নয়, অতি সাধারণ দৃশ্য। ছেড়া কাঁথা রিপু করা হচ্ছে।
ভইনডি!
হুঁ।
ঘুমান আরাম কইরা ঘুমান।
জাহেদা কাঁথা সেলাই করতে করতে বিড় বিড় করে নিজের মনেই কথা বলছে। কথাগুলি আমার কানে আসছে গানের মত। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। গাঢ় শান্তিময় ঘুম।
ঘুম ভেঙ্গে দেখি রাত হয়ে গেছে। জাহেদা ঘরে বাতি জ্বালায় নি। চারদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কী অদ্ভুত কান্ড কতক্ষণ ধরে ঘুমুচ্ছি? ঘরের পেছনের বাঁশবনে বাতাস লেগে ভূতুড়ে শব্দ হচ্ছে। আমি ভয় পেয়ে ডাকলাম, জাহেদ জাহেদা।
জাহেদা ঘর থেকে বের হল। তার হাতে কুপী। সে কুপী জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, লম্বা একটা ঘুম দিছেনগো ভইনডি। সইন্ধ্যাকালে দুইবার ডাকছি। সাড়া দেন নাই। মরা ঘুম ঘুমাইছেন গো ভইনডি। মরা ঘুম। আফনের খুঁজে মানুষ আসছে।
কে এসেছে?
মওলানা আসছে। বাইরের বাড়িত বইস্যা আছে। আমারে বলছে, ঘুম ভাঙ্গানির দরকার নাই। আরাম কইরা ঘুমাইতাছে ঘুমাউক। মানুষের নিদ্রাও ইবাদৎ। আফনেরার এই মওলানা লোক ভাল।
আমি বাইরে এসে দেখি মওলানা সাহেব বাংলা ঘরের উঠানে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাঁর গা দিয়ে ভুর ভুর করে আতরের গন্ধ আসছে। আজ মনে হয় প্রাণ ভরে গায়ে আতর মেখেছেন। তার হাতে লম্বা টর্চ। এরকম লম্বা টর্চ এর আগে আমি দেখি নি। মওলানা বললেন, ঘুম কেমন হয়েছেগো আম্মাজী?
ঘুম খুব ভাল হয়েছে।
পাঁচটা মিনিট আম্মা। এশার আযান হয়েছে। নামাজটা পড়ে রওনা দিব। অজু আছে দিরং হবে না।
গায়ে এত আতর দিয়েছেন কেন? গন্ধে মাথা ঘুরছে।
মনটা খুব খারাপ হয়েছে এই জন্যে আতর দিয়েছি। চোখে সুরমাও দিয়েছি। রাত্রি বিধায় দেখতে পাচ্ছেন না। মন খারাপ হলে সুগন্ধ মাখলে ভাল লাগে।
শুটিং বন্ধ হয়ে গেছে এই জন্যে মন খারাপ। তিথিকণা আম্মা হঠাৎ বলল, অভিনয় করব না। এই মেয়ে বড় শক্ত। না মানে না।
কী নিয়ে রাগ করেছে?
সঠিক বলতে পারব না। বয়স অল্প। অল্প বয়সের রাগের জন্য কারণ লাগে। বয়সটাই রাগের। আম্মাজী জাহেদারে নামাজের জন্যে পাটি টাটি কিছু দিতে বলেন। একটু কষ্ট দেই আম্মাজীরে। মনে কিছু নিয়েন না।
আমি নিজেই পাটি এনে দিলাম। মওলানা. পার্টিতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আম্মাজী আপনার একটা পত্র আছে আমার কাছে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আমার চিঠি? কে দিয়েছে?
স্যারের স্ত্রী। নীরা ম্যাডাম দিয়ে গেছেন। বলেছেন–সময় সুযোগ মত আপনার হাতে দিতে। সময় সুযোগ পাচ্ছিলাম না। দিতে পারি নাই।
আমি হাত বাড়িয়ে খাম বন্ধ চিঠি নিলাম। মওলানা বললেন, ম্যাডাম বলে গেছেন, চিঠি পড়া শেষ হলে আমি যেন আপনার কাছ থেকে নিয়ে নষ্ট করে ফেলি। আম্মাজী এক কাজ করেন। চিঠি এইখানেই পড়েন। এই ফাঁকে নামাজ আদায় করে ফেলি। আছরের নামাজ কাজা হয়েছিল। আর নামাজ কাজা করব না।
নীরা ম্যাডাম যাবার সময় আপনাকে এই চিঠি দিয়ে গেছেন?
জ্বি। আর হাতের এই টর্চ লাইটটাও দিয়ে গেছেন। বড় ভাল মেয়ে আমাকে অত্যন্ত পেয়ার করেন। আগে আমাকে আপনি করে বলতেন। এখন তুমি করে বলেন।
আমি মওলানা সাহেবের হাত থেকে চিঠি নিয়ে কুপির আলোয় পড়তে বসলাম। জাহেদা তার কাজকর্ম করে যাচ্ছে। আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। বকটা আমার খুব কাছাকাছি। বকের একটা বিরাট ছায়া পড়েছে দেয়ালে।
রুমালী,
কিছু কিছু জিনিস আমি ভয়ঙ্কর অপছন্দ করি। চিঠি লেখা তার মধ্যে একটি। অনেককেই তার অপছন্দের কাজ বাধ্য হয়ে করতে হয়। জীবনের অনেক আয়রনির একটি হচ্ছে অপছন্দের কাজটি বেশি বেশি করা। যে চিঠি লিখতে অপছন্দ করে দেখা যায় তার জীবিকাই হয় চিঠি লেখা। পোস্টাপিসের সামনে সে টুল পেতে বসে থাকে। একটাকা দুটাকার বিনিময়ে চিঠি লিখে দেয়। আমি সে রকম না। অপছন্দের কাজ আমি করি না। চিঠি লেখা আমার জীবিকা নয়। আমার যা বলার তোমাকে সরাসরিও বলতে পারতাম। বলতে ইচ্ছে করল না। বলতে গ্লানিবোধ হল।
চিঠি লিখতেও গ্লানিবোধ করছি— তবে চিঠির সুবিধাটা হচ্ছে আমার গ্লানিবোধ তোমাকে দেখতে হচ্ছে না। কেউ চায় না তার লজ্জা অন্যের সামনে তুলে ধরতে। শরীরের লজ্জা আমরা কাপড় দিয়ে ঢাকি। মনের লজ্জা কী দিয়ে ঢাকব?
আমি ঢাকায় রওনা হবার আগে আগে মঈনকে বলে এসেছি— তুমি অবশ্যই রুমালীকে তোমার ছবি থেকে বাদ দেবে। এবং কেন বাদ দেয়া হল তা গুছিয়ে বলবে। সেই গুছিয়ে বলার মধ্যে যেন কোনরকম অস্পষ্টতা না থাকে। সে বলেছে, আচ্ছা।
আমি জানি সে কিছুই বলবে না। সত্য আগুনের মত। সবাই সেই আগুনের সামনে দাঁড়াতে পারে না। আমার মত শক্ত মেয়েই পারে না, আর ও নিতান্তই দুর্বল একজন মানুষ। কাজেই আমি বাধ্য হয়ে এই দীর্ঘ চিঠি লিখলাম। এবং মওলানা সাহেবকে দিলাম তিনি যেন যথাসময়ে চিঠিটা তোমার হাতে দেন। মওলানাকে আমার পছন্দ হয়েছে। মঈনের অনেক গুণের মধ্যে একটি গুণ হচ্ছে পাথরের গাদার ভেতর থেকে সে মানিক খুঁজে নিতে পারে। যাদেরকে সে খুঁজে নেয় তারা তাকে ভালবাসে অন্ধের মত। তারা তাকে ঘিরে রাখে কঠিন দেয়ালে। যেন দেয়াল ভেঙ্গে কেউ তার ক্ষতি করতে না পারে। পৃথিবীর কোন যুক্তির ক্ষমতা নেই সেই দেয়ালে ফাটল ধরাবে।