জাহেদার উঠোনে বকটা গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটছে। এর নাম ধলামিয়া। ধলা মিয়া বলে ডাক দিলে বৃদ্ধ মানুষের মত টুকটুক করে হেঁটে আমার কাছে আসার কথা। আমি ডাকলাম, ধলামিয়া ধলামিয়া। বকটা ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখল তারপর ছোট ছোট পা ফেলে আমার দিকে আসতে শুরু করল। কী অদ্ভুত দৃশ্য। ডিরেক্টর সাহেবকে এই ব্যাপারটা বলা দরকার, এবং দৃশ্যটাও তাঁকে দেখানো দরকার। আমার ধারণা দৃশ্যটা দেখা মাত্র তিনি তাঁর ছবিতে ঢুকিয়ে দেবেন। নতুন একটা সিকোয়েন্স তৈরি করবেন। যেমন দিলু নিজের মনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এক বাড়িতে ঢুকে শোনে, এই বাড়িতে একটা পোষা বক আছে। যার নাম ধলামিয়া। নাম ধরে ডাকলেই যে গুট গুট করে হেঁটে কাছে আসে! দিলু অল্পতেই মুগ্ধ হয়। এই ঘটনা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হল। দৃশ্যটা জামিল ভাইকে সে দেখাবেই। জামিল তার কথা পাত্তাই দিলেন না। বক আবার মানুষের কথা শুনে কাছে আসে না-কি?
আচ্ছা আল্লাহতালা কী করেন? তিনিও কি নতুন নতুন দৃশ্য তৈরি করে মূল দৃশ্যমালায় ঢুকিয়ে দেন। নতুন দৃশ্যগুলি তাঁর আদি পরিকল্পনায় ছিল না, হঠাৎ মাথায় এসেছে।
ভইনডি কেমুন আছেন গো?
আমি চমকে পেছনে ফিরলাম। খলুই হতে জাহেদা ঠিক আমার পেছনে। তার খলুই ভর্তি গোবর। তার হাতও গোবরে মাখা মাখি। কাউকে গোবর নিয়ে মাখামাখি করতে দেখলে অন্য সময় আমার গা ঘিন ঘিন করে উঠত। এখন করছে না। এখন মনে হচ্ছে এটাই স্বাভাবিক। জাহেদার হাত গোবরে মাখামাখি না থাকলে মানাতো না।
জাহেদা আপনি কেমন আছেন?
জাহেদা হাসতে হাসতে বলল, আমি ভাল আছি গো ভইনডি। তয় আমার লোকটা নিরুদ্দেশ হইছে।
নিরুদ্দেশ হইছে মানে কী?
দুইদিন আগে হাটে যাইব বইলা বাইর হইছে আর ফিরে নাই।
সে কী।
জাহেদা হাসছে। শরীর দুলিয়ে হাসছে। স্বামীর নিরুদ্দেশ হওয়াটা যেন বড়ই আনন্দময় সংবাদ।
চিন্তার কিছু নাই। আবার ফিরা আসব। আর না আসলে নাই। পশু পাখিও শিকল দিয়া বান্দন যায় না। আর মানুষ বইল্যা কথা।
উনি কি প্রায়ই নিরুদ্দেশ হয়ে যান?
হুঁ। তার বাতাস রোগ আছে।
বাতাস রোগটা কী?
বাতাস রোগটা যার থাকে হে বাতাস পাইলেই উইড়া যায়। হে খুঁজে রঙ্গিলা বাতাস।
ও আচ্ছা। বাতাস রোগের কথা এই প্রথম শুনলাম।
ভইনড়ি আফনে কি কোন কামে আসছেন?
না। আমি আপনের সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।
আসেন গফ করি। খাড়ান হাত ধুইয়া আসি।
জাহেদা আমাকে পাটি পেতে দিল। পাখা এনে দিল। ফুল তোলা ওয়ারের বালিশ এনে দিল। পান সুপারি এনে দিল। খালি পেটে পান খেতে কেমন লাগে দেখার জন্যে আমি পান খাচ্ছি। একটা আয়না থাকলে দেখতাম আমার ঠোঁট লাল হয়েছে কি না। ঠোঁট যদি টকটকে লাল হয় তাহলে বুঝতে হবে আমার স্বামী আমাকে পাগলের মত ভালবাসবে।
জাহেদা!
বলেন ভইনডি।
দেখুনতো আমার ঠোঁট লাল হয়েছে কি না।
হইছে ভইনডি। খুব লাল হইছে।
থ্যাংক য়্যু।
আপনের মনডা কি খারাপ?
হ্যাঁ আমার মন খুব খারাপ।
জাহেদা কুটকুট করে হাসছে। মুখে আঁচল চেপেও হাসি থামাতে পারছে না। আমার মন খারাপ শুনে তার হাসি পাচ্ছে কেন? মেয়েটা কি পাগল?
হাসছেন কেন?
আপনের মন ভাল হইয়া যাইব। খুব ভাল হইব।
কখন মন ভাল হবে?
এক দুই দিনের মইধ্যে।
আপনার কথাতো একটাও ঠিক হয় না। আপনি বলেছিলেন চণ্ডিগড়ে কোন শুটিং হবে না। একজন মানুষ মারা যাবে। কই কেউতো মারা যায় নি। শুটিংও ঠিকমতই হচ্ছে।
ভইনডি আমার কথা মাঝে মাঝে লাগে। মাঝে মাঝে লাগে না।
সবার বেলাতেই তো এমন হয়। সবার কথাই মাঝে মাঝে লাগে। মাঝে মাঝে লাগে না।
তাও ঠিক।
আকাশে কি মেঘ জমতে শুরু করেছে? আলো কেমন মরে আসছে। আমি মেঘ দেখার জন্যে আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘ নেই, কিন্তু রোদ মরে যাচ্ছে, আশ্চর্য তো! জাহেদা বলল, আইজ রাইত ঝুম তুফান হইব।
তাই বুঝি?
হুঁ, ঝুম তুফান হইব। সোমেশ্বরী নদীত বান ডাকব। হাতি ভাসাইন্যা বান।
আপনার মন এইসব খবর আপনাকে দিচ্ছে, না-কি আকাশের অবস্থা দেখে বলছেন।
মন বলতাছে।
আপনের স্বামী কবে ফিরবে?
তাতো ভইনড়ি বলতে পারব না।
স্বামীর ব্যাপারে মন কিছু বলছে না?
জ্বে না।
বকটাকে ডাকা হয় নি। তারপরেও সে নিজের মনে হাঁটতে হাঁটতে আসছে। আমার দিকেই আসছে। বকটা বড় হয়েছে মানুষের সঙ্গে, কিন্তু সে মনে হয় একজন মানুষকে অন্য একজনের কাছ থেকে আলাদা করতে পারে না। আমরা যেমন একটা বককে অন্য একটা বক থেকে আলাদা করতে পারি না, তারাও আমাদের পারে না। সে আমাকে জাহেদা ভেবেই আমার কাছে আসছে।
জাহেদা পেছন থেকে ডাকল ধলামিয়া। ধলামিয়া। কটা দাড়িয়ে গেল। সে একবার দেখছে জাহেদাকে, একবার আমাকে। মনস্থির করতে পারছে না কার কাছে যাবে। কী করে দেখার জন্যে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, এবং আমিও ডাকলাম ধলামিয়া। পাখিটা আমার কাছেও এল না, জাহেদার কাছেও গেল নাস্থির হয়ে রইল।
জাহেদা শান্ত গলায় বলল, ভইনডি ধলামিয়া আন্ধা। চউক্ষে দেখে না।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, সে কী।
ছোট বয়সে এরে যখন ধইরা আনে তখন চউক্ষে হাত লাইগ্যা চউখ নষ্ট হইছে। বকটা আন্ধাগো ভইনডি। হে মানুষ চিনে না।
আমার বুকে ধাক্কার মত লাগল। পাখি অন্ধ হতে পারে? এর কেউ নেই। কোন সঙ্গিনী এর পাশে বসে না। এ উড়ে আকাশে যেতে পারে না। সারাদিন নিজের অন্ধকার ভুবনে আপন মনে হাঁটে। আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি অনেকক্ষণ ধরেই কাঁদতে চাচ্ছিলাম— কাঁদতে পারছিলাম না। অন্ধ পাখিটা আমাকে কাঁদিয়ে দিল। আমি ডাকলাম— ধলামিয়া আয় আয় আয়রে লক্ষ্মী আয়।