কাউকে কিছু না বলে চলে যাব?
যারা আমার মেয়ের গায়ে থুথু দিয়েছে তাদের বলাবলির কী আছে?
ওরা ভুল করেছে বলে আমরা কেন ভুল করব মা? আমরা ভুল করব না। আজ রাতে শুটিং এর শেষে আমি সবার কাছ থেকে হাসি মুখে বিদেয় নেব, পরদিন সকালে চলে যাব।
না আমি এখনি যাব।
তুমি এখনি যেতে চাইলে যাও। আমি তোমাকে বাসে তুলে দিয়ে আসব। কিন্তু আমি চোরের মত পালিয়ে যাব না। আমি কোন চুরি করি নি যে আমাকে চোরের মত পালিয়ে যেতে হবে।
মা শব্দ করে কাঁদছেন। গোংগানীর মত শব্দ হচ্ছে। মার কান্না দেখে আমার কেন যেন মায়া লাগছে না। রাগ লাগছে। কান্নার শব্দ শুনে লোকজন জড় হবে। জানতে চাইবে কী ব্যাপার। কী বিশ্রী?
বকুল।
মা বল, আমি শুনছি।
তুই আমার সামনে থেকে যা। তোকে আমার সহ্য হচ্ছে না।
কোথায় যাব?
যেখানে ইচ্ছা যা তোর দেবতার সামনে হা করে বসে থাক। দেবতাকে পূজা কর গিয়ে। দেবতা তোর গায়ে যে থুথু দেবে— সেই থুথু চেটে চেটে খা…
এইসব কী বলছ?
আমি কী বলছি আমি জানি। তোকে আমি গর্ভে ধরেছি। আমি তোর গর্ভে জন্মই নি। আমি বোকা সেজে থাকি বলেই তুই আমাকে বোকা ভাবিস–শোন বুদ্ধিমতী যে রাতে তুই ঘটনা ঘটিয়েছিস আমি সেই রাতেই টের পেয়েছি। তুই মরার মত ঘুমুচ্ছিলি আমি সারারাত তোর পাশে জেগে বসেছিলাম। সারারাত নিজের মনে কী বলেছি শুনতে চাস?
না শুনতে চাই না।
সারারাত আমি আল্লাহকে বলেছি— আমি এত কী পাপ করেছি যে তুমি আমাকে এত শাস্তি দিচ্ছ? যে মেয়েকে বুকে নিয়ে জীবন কাটাব ভেবেছিলাম–এখন দেখি সেই মেয়ে বাজারের একটা নষ্ট মেয়ে।
তুমি কি দয়া করে চুপ করবে মা?
তোর দেবতা কি তোকে বিয়ে করবে? করবে না, পূজা নেবে কিন্তু বিয়ে করবে না। দেবতারা বোকা হন না। তারা দেবী বিয়ে করেন তারা বাজারের নষ্ট মেয়ে বিয়ে করেন না। বড়জোড় কিছুক্ষণ কচলাকচলি করেন। তার পর ঘেন্নায় থুথু দেন। তোর জীবন কাটবে দেবতার থুথু গায়ে মেখে।
মা হাতজোড় করছি চুপ কর!
চুপতো করবই। চুপ করা ছাড়া আমার গতি কী? আমি চুপ করব–আর কথা বলব না। শুধু তোর ভবিষ্যৎটা কী হবে বলে চুপ করি। আমি চোখের সামনে তোর ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।
আমার ভবিষ্যটা তুমি রাতে বলো মা। রাতে খুব মন দিয়ে শুনব।
না রাতে না। এখনই শোন। আমি ঢাকায় যাব–তারপর তোকে নিয়ে আমি ক্লিনিকে ক্লিনিকে ঘুরব। তোর পেট খালাস করতে হবে….
মা ছিঃ।
খবরদার তুই ছিঃ বলবি না। খবরদার। ছিঃ বলতে হলে আমি বলব। তুই বলবি না। বেশ্যা মেয়ের মুখে ছিঃ মানায় না। যা আমার সামনে থেকে, যা। তোর মুখের দিকে তাকালেও পাপ হয়।
আমি ঘর থেকে বের হলাম। মা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি শুনতে পাচ্ছি, মা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন— বেশ্যা। আমার মেয়ে বেশ্যা।
জালালের মা কোত্থেকে উদয় হয়েছে। তার মুখ ভর্তি পান। সে পানের পিক ফেলে আরেকটু এগিয়ে এল। মা কী বলছেন ভাল মত শুনতে হবে। আমি হাঁটছি। কোথায় যাচ্ছি জানি না। একবার কি পেছনে ফিরে দেখব মার দরজার সামনে আরো লোক জড় হয়েছে কি না? না থাক।
দুটার মত বাজে। এখন কোথায় যাব? গ্রামের পথে একা একা হাঁটব? সোমেশ্বরী নদীর পানি দেখতে যাব? না-কি কোন গারো বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বলব, আপনারা কেমন আছেন? আমি আপনাদের দেখতে এসেছি। আমার খুব পানির তৃষ্ণা, আপনারা আমাকে ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দিন না।
পানির তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। খুব ঠান্ডা এক গ্লাস পানি যদি আমাকে কেউ দিত। ক্ষিধেও পেয়েছে। সকালে বড় মগ ভর্তি এক মগ চা খেয়েছি— এরপর আর কিছু খাওয়া হয় নি। ও না খেয়েছি, শুটিং চলার সময় আর একবার চা খেয়েছি। ক্ষিধেয় এখন নাড়ি কামড়াচ্ছে। ক্ষিধের দোষ নেই। ক্ষিধের কাছে মানুষ পরাজিত হবেই। ক্ষিধের কাছে পরাজয় মানে শরীরের কাছে পরাজয়। মানুষ বার বার শরীরের কাছে পরাজিত হয়েছে। মনের কী প্রবল ক্ষমতা, কিন্তু তার পরেও শরীরের কাছে সে কত অসহায়।
আচ্ছা জাহেদার কাছে গেলে কেমন হয়। জাহেদাকে জিজ্ঞেস করতে পারি— জাহেদা তোমার কাছে পাকা মন-ফল আছে। থাকলে কয়েকটা মন-ফল দাওতো খেয়ে দেখি। মন-ফল কি মনের জোর বাড়ায়? দ্বিধা সংকোচ কাটিয়ে দেয়?
আমি রোদে নেমে পড়লাম। ভয়ংকর কোন কাণ্ড করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কেউ এখন আমার দিকে তাকাচ্ছে না। এমন কোন কাণ্ড কি করা যায় যেন সবাই চমকে তাকায় আমার দিকে। ডিরেক্টর সাহেব হতভম্ব গলায় বলেন–কী হল?
সিনেমার গল্পে দিলু এমন একটা কাণ্ড করেছিল। বেচারীর দিকে কেউ তাকাচ্ছিল না। শেষটায় এমন এক কাণ্ড সে করল যে সবাই বাধ্য হল তাকাতে। সে নিজে কিন্তু তা জানতে পারল না। দিলু তখন দিঘীর নীল জলে টকটকে লাল রঙের স্কার্ট পরে ভাসছিল। আমার লাল স্কার্ট নেই, কিন্তু লাল শাড়িতে আছে। দিঘীর নীল জলে লাল শাড়ি খুব মানাবে।
মেঘ কেটে রোদ উঠেছে। প্রচন্ড রোদ। আকাশ আঁ আঁ করছে। প্রচণ্ড রোদের সময় চারদিক কি একটু ঘোলাটে লাগে? আমার লাগছে। মনে হচ্ছে হালকা করে কুয়াশা হয়েছে।
রাস্তার দুপাশে পানিতে নাক ডুবিয়ে মহিষের দল শুয়ে আছে। পানির উপর শুধু নাক ভেসে আছে আর কিছু নেই। মহিষের নাক ভাসিয়ে ডুবে থাকার দৃশ্যটা কি ডিরেক্টর সাহেব নিয়ে রেখেছেন? না নিয়ে রাখলেও তিনি নেবেন। কোন সুন্দর দৃশ্যই তাঁর চোখ এড়াবে না। যা কিছু সুন্দর তিনি বন্দি করে ফেলবেন সেলুলয়েডে। সেলুলয়েডে যা বন্দি করা যায় না তার প্রতি তার আগ্রহ নেই। মানুষের মন বন্দি করা যায় না বলেই কি মানুষের মনের প্রতি তাঁর এত অনাগ্রহ?