আমি তখনই তা করব। কেন করব কী জন্যে করব তা আমি জানি না। কিন্তু আমি অবশ্যই করব। আমি আবার হাসলাম। আমি জানি হাসলে আমাকে খুব সুন্দর দেখায়। আমি কি কখনো আমার হাসি উনাকে দেখাতে পারব? না পারব না। কারণ আমি তাকে কিছু দেখাতে চাই না। আমি কাউকেই কিছু দেখাতে চাই না। নিজেকেও না। আমি নিজেকে নিজের কাছে আড়াল করে রাখতে চাই।
রোদ আরো বেড়েছে। চারদিক ঝকঝক করছে। গল্প উপন্যাসে মাটির গন্ধের কথা পড়েছি। এখন আমি মাটির গন্ধ পাচ্ছি। কড়া গন্ধ। এই গন্ধে ঝিম ধরানো ভাব থাকে। কিছু গন্ধ থাকে যা গায়ে মাখতে ইচ্ছা করে। মাটির গন্ধ হল সে রকম গন্ধ। ফুলের গন্ধ গায়ে মাখতে ইচ্ছা করে না। সুন্দর কোন কৌটায় জমিয়ে রাখতে ইচ্ছা করে।
আমি এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছি। আমার মা বোধ হয় এখনো জানেন না যে আমি রোদের মধ্যে হাঁটছি। জানতে পেলে ছুটে আসতেন। গ্রামে আমার এই প্রথম আসা। যা দেখছি তাই ভাল লাগছে। মুগ্ধ হয়ে একটা বরই গাছের সামনে দাঁড়ালাম। বরই গাছতো কতই দেখেছি। বরই গাছ দেখে কখনো মুগ্ধ হই নি। এই গাছ দেখে মুগ্ধ হচ্ছি কারণ পুরো গাছ সোনালী রঙের চাদর দিয়ে ঢাকা। খুব সরু সোনালী লতা গাছটাকে ঢেকে ফেলেছে। রোদের আলোয় ঝলমল করছে। ক্যামেরা সঙ্গে থাকলে ছবি তুলতাম। ক্যামেরা সঙ্গে নেই–মার ব্যাগে আছে। ছোট্ট ভিভিটার ক্যামেরা হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা যায়। ছোট্ট হলেও দামী–খুব ভাল ছবি ওঠে।
এই ক্যামেরাও মার উপার্জন। তিনি একদিন বাবার কাছে গিয়ে বললেন— পরশু তোমার মেয়ের জন্মদিন। সে ষোল বছরে পড়ল। এই মেয়েতো পথে ফেলে দেয়া মেয়ে। তার জন্মদিনে তুমি আসবে এটা আমরা ভাবি না—তোমাকে আসতেও বলব না। তোমার মেয়ে তোমার কাছে একটা উপহার চেয়েছে তাকে তুমি একটা দামী ক্যামেরা দেবে। অটোমেটিক ক্যামেরা। তোমার কাছেতো হয়ে মুখ ফুটে কোনদিন কিছু চায় নি,–এই প্রথম চাচ্ছে। তুমি কিনে এনে খবে আমি কাল এসে নিয়ে যাব। বায়তুল মোকাররমের দোকানে পাওয়া যায়, দেখে শুনে কিনবে— সেকেন্ড হ্যান্ড যেন না হয়। সিঙ্গাপুর মেড না, জাপান মেড।
বাবা ক্যামেরা কিনে দিলেন। মা ঝলমল মুখে ক্যামেরা নিয়ে এলেন।
আমি মাকে বললাম, ক্যামেরা ভিক্ষা চাইতে তোমার লজ্জা লাগল না মা?
মা বিস্মিত হয়ে বললেন, লজ্জা লাগবে কেন? তুই তার মেয়ে না? নাকি আমি অন্য মানুষের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে তোকে পেটে এনেছি।
ছিঃ মা এইসব কী ধরনের কথা?
তুই যে ধরনের কথা বলিস তার উত্তরে এইসব কথাই বলতে হয়। আমাদের যা দরকার আমরা আদায় করে নেব। ছলে বলে কৌশলে যে ভাবে পরি আদায় করব।
এই ক্যামেরা আমি নেব না মা।
নিতে না চাইলে নিবি না। আমার কাছে থাকবে। তোর নাটক-টাটকের রেকর্ডিং যখন হবে তখন এই ক্যামেরায় আমি তোর ছবি তুলব।
এই ক্যামেরায় আমি কোনদিন আমার ছবি তুলতে দেব না।
না দিলে না দিবি।
মা খুব আনন্দিত। আমার কঠিন কথাতেও তার আনন্দের কোন কমতি হল। তিনি হাসি মুখে ক্যামেরা গুছিয়ে রাখলেন। বুঝতে পারছি জিনিসটা তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। আমার যখন কোন রেকর্ডিং থাকে— মা হাসিমুখে ক্যামেরা নিয়ে উপস্থিত হন। আশে পাশে কে আছে না আছে কোন খেয়াল না করে বলেন–দেখি বকু, আমার দিকে তাকা। মুখটা হাসি হাসি কর। ওমা ঠোঁটটা আরেকটু ফাঁক কর— এত অল্প ফাঁক না। দেখি চুলগুলি সামনে এনে দে না। উঁহু ডান দিকে না, বাম দিকে। মুখটা একটু উঁচু কর। চোখে আলো পড়ছে না, চোখ অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। হয়েছে—এখন বল চীজ।
আমি বলি—চীজ।
মানুষ যদি ঝিনুকের মত হয় তাহলে আমি মায়ের ঝিনুকের ভেতর বসে আছি। মা ডালা বন্ধ করে রেখেছেন। ডালাবন্ধ ঝিনুকের ভেতরের গরমে আমার অসহ্য বোধ হলেও আমিতো জানি মা ভালবাসার রসে ডুবিয়ে ডুবিয়ে আমাকে মুক্তা বানানোর চেষ্টা করছেন। পরিপূর্ণ মুক্তা হবার পর ঝিনুক কী করে? ডালা খুলে মুক্তা উগরে ফেলে দেয়? না-কি চিরজীবন বুকের ভেতর ধরে রাখে?
কী দেখছেন?
আমি চমকে তাকিয়ে দেখি সেলিম ভাই। আমাকে প্রশ্নটা করে তিনি নিজেই যেন লজ্জায় মরে যাচ্ছেন। সেলিম ভাই আমাদের ইউনিটের সঙ্গে আছেন। তাঁর কাজটা কী এখনো জানি না। তিনি অভিনেতাদের কেউ না। কারণ তিনি শিল্পীদের সঙ্গে থাকেন না, বা শিল্পীদের সঙ্গে খেতেও বসেন না। তিনি থাকেন ইউনিটের লোকদের সঙ্গে। খাওয়া দাওয়াও তাদের সঙ্গে করেন। তবে ইউনিটের কোন কাজ করেন না। খুবই বিব্রত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ান। যেন সিনেমার দলের সঙ্গে ঢুকে পড়ে খুব লজ্জায় পড়েছেন। আমি সেলিম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললাম, বরই গাছটা কেমন সোনালী চাদর গায়ে দিয়ে জড়সড় হয়ে আছে তাই দেখছি। খুব সুন্দর না?
জ্বি সুন্দর। এই লতাটার নাম স্বর্ণলতা।
আপনি কি খুব গাছ গাছড়া চেনেন?
গ্রামের ছেলেতো—গাছ চিনব না কেন?
আপনি গ্রামের ছেলে?
জি। স্কুল কলেজ সবই গ্রামে। গ্রাম থেকেই বি.এ. পাস করেছি।
এখন কী করছেন?
কিছু করছি না। এম.এ. পড়ার শখ ছিল। টাকা পয়সা নেই। বি.এ. পরীক্ষার রেজাল্টও ভাল হয় নি। এই রেজাল্টে এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হওয়াও সমস্যা।
আপনার রেজাল্ট কী?
সেকেন্ড ক্লাস তাও খুব নীচের দিকে। থার্ড ক্লাস হতে হতে হয় নি।
সিনেমার দলের সঙ্গে ঘুরছেন কেন?
আমি মঈন স্যারের কাছে গিয়েছিলাম একটা চাকরির জন্য। উনি বিখ্যাত মানুষ-উনার কত জানাশুনা, উনি একটু বলে দিলেই আমার একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। এই আশায় যাওয়া। উনি বললেন আমার সঙ্গে দুর্গাপুরে চল। চলে এসেছি।