খুব সুন্দর হবে।
তুমি একটা ফড়িং ধরে আমার কাছে নিয়ে এসো।
জ্বি আচ্ছা।
উনি চলে গেলেন উনার জায়গায়, আমি গেলাম ফড়িং ধরতে। ফড়িং ধরার জন্যে ইউনিটে অনেক লোক আছে। যে কোন প্রোডাকশন বয়কে ফড়িং ধরতে বললে সে মুহূর্তের মধ্যে পঞ্চাশটা ফড়িং ধরে নিয়ে আসবে। তা না করে তিনি আমাকে ফড়িং ধরতে বললেন। কাজটার পেছনে তার একটা উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটা কী? আমাকে এবং অন্য সবাইকে দেখানো যে সব স্বাভাবিক আছে? আমাকে সহজ করা? তার প্রয়োজন ছিল না, আমি সহজ স্বাভাবিক হয়েই আছি।
তিথিকণার মেকাপ শেষ হয়েছে। মেয়েটা খুব সুন্দর। মেকাপের পর তাকে দেখাচ্ছে ইন্দ্রাণীর মত। শট দেবার জন্যে সে তৈরি। ভীত এবং লজ্জিত ভঙ্গিতে সে হাসছে। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে–অভিনয়টা সে ভাল পারবে। এ রকম কেন মনে হচ্ছে বুঝতে পারছি না। বরং উল্টোটা হবার কথা, কারণ ডিরেক্টর সাহেব তাকে কী বলছেন তা সে মন দিয়ে শুনছে না, বার বারই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ডিরেক্টর সাহেবের কথার মাঝখানেই একবার সে তার মার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। ডিরেক্টর সাহেব বললেন— তিথি আমি কী বলছি মন দিয়ে শোন! তুমি তোমার জীবনের একটা ট্রানজিশন পয়েন্টে আছ। এই তুমি কিশোরী— এই তুমি তরুণী এমন অবস্থা। বুঝতে পারছ কী বলছি?
হুঁ।
মেয়েটির মা বললেন–বলছ কেন? বল—জ্বি।
জ্বি।
ডিরেক্টর সাহেব বললেন, এই ফড়িংটা হাতে নাও। দু আঙ্গুলে পাখা দুটা ধর।
তিথি বলল, অসম্ভব আমি মরে গেলেও ফড়িং ধরব না, ঘেন্না লাগে।
ডিরেক্টর সাহেব বললেন, ঘেন্না লাগার কী আছে, ফড়িং কী সুন্দর একটা পতঙ্গ।
তিথিকণা বলল, সুন্দর পতঙ্গ হলে আপনি ধরে বসে থাকুন। আমি ধরব না।
তিথির মা বললেন, এইসব কী বেয়াদবের মত কথা। কার সঙ্গে কথা বলছ খেয়াল থাকে না? সরি বল।
তিথি বলল, সরি সরি সরি।
এইবার আংকেল যা বলছেন কর— ফড়িংটা ধর।
বললাম না মা, আমার ঘেন্না লাগে। তোমাকে যদি একটা পেট মোটা মাকড়শা ধরতে বলা হয় তুমি ধরবে? তুমিতো মাকড়শা দেখেই ফিট হয়ে পড়ে যাবে।
ফড়িংতো আর মাকড়শা না।
ফড়িং মাকড়শার চেয়েও খারাপ। যা যা করতে বলা হবে আমি করব, কিন্তু ফড়িং ধরব না। আর যদি ধরতে হয় হাতে গ্লাভস পরে নেব। আমার জন্যে গ্লাভস্ আনাতে হবে।
তিথি শেষ পর্যন্ত ফড়িং হাতে নিয়ে দৃশ্যটা করল। এত সুন্দর করল যে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। পাপিয়া ম্যাডাম বললেন–বাহ্ চমৎকারভো। মেয়েটাতো দারুণ।
জামিল ভাইয়ের সঙ্গে তার দৃশ্যটা আরো সুন্দর হল। বই ছিড়ে পানিতে ফেলে দেয়া। রাগ করে দৌড়ে ছুটে যাওয়া। ক্যামেরায় ছবি তোলার সময় চমকে তাকানো।
আমার কাছে সবচে ভাল লাগল–তার ক্যামেরায় ছবি তোলার অংশটা। সেলিম ভাই ছবি তুলছেন। তিথির হাতে ফড়িং। সেলিম ভাই (চিত্রনাট্যের সাব্বির) বললেন–রেডি ওয়ান-টু…. থ্রি বলার ঠিক আগে আগে তিথি ফাজলামি করে ঠোঁট দুটো গোল করে ফেলল। অপূর্ব দৃশ্য। তাদের বয়েসী মেয়েরা ছবি তোলার সময় এ রকম কাণ্ড কারখানা করে। আমি কি এরকম করতাম? না করতাম না। তিথি করছে কারণ একটা সিনেমা তৈরি হচ্ছে এ ব্যাপারটা তার মাথার মধ্যে নেই। সে ঘরে যা করে এখানেও তাই করছে। পুরো ব্যাপারটা সে নিয়েছে খেলার মত।
লাঞ্চ ব্রেকের সময় আমি ক্যাম্পে ফিরে গেলাম। তিথিও আমার সঙ্গে আসছে। সে গোসল না করে দুপুরের খাবার না-কি খেতে পারে না। ভালমত সাবান ডলে গোসল করবে। তারপর খাবে। খাবার পর আবার মেকাপ নিয়ে অভিনয়ের জন্যে তৈরি হবে। শুধু আজ গোসল না করে খেয়ে ফেলার ব্যাপারে তাকে অনেক বলেও রাজি করানো যায় নি। তিথির মা তার সঙ্গে আসতে চাচ্ছিলেন। তিথি বলেছে— মা তোমাকে আসতে হবে না। তুমি লাঞ্চ কর। আমি সোহরাব চাচার সঙ্গে যাচ্ছি, উনার সঙ্গে ফিরে আসব।
আমরা তিনজন ক্যাম্পের দিকে ফিরছি। সবার আগে সোহরাব চাচা তার একটু পেছনে আমরা দুজন। আমি বললাম তিথিকণা তোমার অভিনয় খুব ভাল হয়েছে। তিথি বলল, তুমি আমার নাম জান কীভাবে?
জিজ্ঞেস করে জেনেছি।
আমাকে দেখে তুমি দোতলার বারান্দা থেকে হাত নাড়াচ্ছিলে?
হ্যাঁ।
কেন?
এম্নি।
তোমার নাম আমি জানি না–তোমার নাম কী?
রুমালী।
বাহ্ কী অদ্ভুত! রুমাল থেকে রুমালী। চাদর থেকে চাদরি। হি হি হি।
তিথি হঠাৎ শুরু করা হাসি হঠাৎই থামিয়ে বলল, চাদরি বলায় রাগ কর নিতো?
না।
আমি যে চরিত্রটা করছি, সেই চরিত্রটা তোমার করার কথা ছিল—তাই না?
হুঁ।
তারপর তোমাকে বাদ দেয়া হয়েছে?
হুঁ।
কেন?
অভিনয় ভাল হচ্ছিল না।
অভিনয় ভাল হবে কি-না সেটা ওরা আগে দেখে নেবে না? ডেকে এনে অভিনয় করিয়ে তারপর বাদ দিয়ে লজ্জা দেবে কেন?
আমি চুপ করে রইলাম। তিথিকে আমার ভাল লাগতে শুরু করেছে। প্রথমেই যাদের ভাল লাগতে শুরু করে তাদেরকে কখনো খারাপ লাগে না। ভাল লাগার পরিমাণ দ্রুত বাড়তে থাকে। তিথি বলল, তোমাকে অভিনয় করার একটা কৌশল শিখিয়ে দেই— কৌশলটা শিখলে দেখবে ভাল অভিনয় করবে।
কৌশলটা কার কাছে শিখেছ?
নিজে নিজেই বার করেছি। কারো কাছ থেকে শিখি নি। আমি বেশির ভাগ জিনিসই নিজে নিজে বার করি। কারো কাছ থেকে শিখি না।
এটাতো ভাল। নিজেই নিজের শিক্ষক।
কৌশলটা হল–অভিনয়ের আগে নিজের মধ্যে একটা রাগ তৈরি করবে। কোন একটা ব্যাপারে হুট করে রেগে যাবে। তারপর রাগটা চাপা দিয়ে অভিনয় করবে। দেখবে অভিনয় ভাল হবে।