শুনলাম তোমার মার শরীর ভাল না?
জ্বি।
সমস্যাটা কী?
জ্বর।
ডাক্তার দেখিয়েছ?
জ্বি।
পাপিয়া ম্যাডামের মেয়েও চায় না–তার মা কারো সঙ্গে কথা বলুক। পাপিয়া ম্যাডাম আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেই মেয়ে তাঁর মায়ের হাত ধরে টানে।
আমি তাদের খেলাটা বুঝতে চেস্টা করলাম। তাতেও মেয়েটির আপত্তি। আমার দিকে তাকিয়ে সে কঠিন গলায় বলল, Dont look at the board. ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখে চমৎকার ইংরেজি শুনলে ভাল লাগে। তাদের কথা শুনতে ইচ্ছে করে। এই মেয়েটা স্বল্পভাষী। তার মা দশটা কথা বললে সে দুটা কথা বলছে। ছোটবেলাতেই যে মেয়ে এত কম কথা বলে–বড় হলে তার অবস্থা কী হবে? খুব বেশি বকবক করবে? না পুরোপুরি চুপ হয়ে যাবে?
আমাকে কেউ তেমন লক্ষ্য করছে না। শুটিং এর সময় সবার সঙ্গে বসে থাকতে যতটা অস্বস্থিকর হবে বলে ভেবেছিলাম ততটা লাগছে না। সবাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ক্যামেরাম্যান আজীজ আংকেল বার বার আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। আকাশে বড় বড় মেঘের খণ্ড। মেঘ ভেসে ভেসে যাচ্ছে। সূর্য ঢাকা পড়ছে। আজীজ আংকেল নিশ্চয়ই মনে মনে হিসেব করছেন— কতক্ষণ সান পাওয়া যাবে। দিনে শুটিং-এর সময় সব ক্যামেরাম্যান সূর্য উপাসক হয়ে যান।
আজ শুটিং খুব কষ্টকর হবে। একটু পর পর সান না পাওয়ার কারণে শট কাট হবে। আর্টিস্টদের উপর খুব চাপ পড়বে। অভিনয়ে ডিসকনটিনিউটি চলে আসবে।
ইউনিটের একটা ছেলে ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে এসেছে। সবাইকে চা দিচ্ছে। লাল টকটকে ফ্লাস্কে চা। চারদিক সবুজ বলেই ফ্লাস্কের লাল রঙ খুব সুন্দর ফুটেছে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে।
অন্য সময় হলে আমি চা খেতাম না। আজ নিজ থেকে চা চেয়ে নিলাম। কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা। চা খাচ্ছি—তাকিয়ে আছি ডিরেক্টর সাহেবের দিকে। আমার তাকিয়ে থাকা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। দেখতে পারছেন না বলেই আমি তাকিয়ে থাকতে পারছি।
আমি ভেবে পাচ্ছি না মানুষটা এত সহজ স্বাভাবিক আচরণ কি করে করছেন। সামান্য অন্যায় করলেও অপরাধ বোধ হয়। যার উপর অন্যায়টি করা হয়েছে তার সামনে সহজ হওয়া যায় না। উনার সহজ ভঙ্গিটা কি অভিনয়? অভিনয় হলে বলতেই হবে তিনি ভাল অভিনেতা।
ডিরেক্টর সাহেব উঠে আসছেন। আমাদের দিকেই আসছেন। আমার কাছে। নিশ্চয়ই না। হয়ত পাপিয়া ম্যাডামকে কিছু বলার জন্যে আসছেন। যেহেতু আমি পাশে আছি— আমাকেও হয়ত কিছু বলবেন— কেমন আছ রুমালী ধরনের কোন কথা। আমাকে খুব সহজ ভাবে জবাব দিতে হবে। ডিরেক্টর সাহেব পাপিয়া ম্যাডামের সামনে দাঁড়ালেন। হাসি মুখে বললেন, দুটার আগে তোমার কোন কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। তুমি ইচ্ছা করলে রেস্ট নিতে পার।
পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, রেস্টইতো নিচ্ছি। ঘরের ভেতর রেস্ট নেবার চেয়ে বাইরে নেয়া কি ভাল না?
বোতাম টিপে কী খেলা খেলছ?
লুডু খেলা। ইলেকট্রনিক লুডু। কৌটার ভেতর ছক্কা নিয়ে চলতে হয় না। বোতাম টিপলেই ডিসপ্লেতে এক থেকে ছয়ের ভেতর একটা সংখ্যা ভেসে ওঠে।
কই গুটি চেলে দেখাওতো।
এখন দেখানো যাবে না। আমার মেয়ে রাগ করবে। আমরা দুজন যখন এক সঙ্গে থাকি তখন সে তৃতীয় কাউকে সহ্য করতে পারে না। এখনি সে কেমন করে তাকাচ্ছে।
ডিরেক্টর সাহেব শব্দ করে হেসে উঠলেন। হাসি থামিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন— রুমালী আমার সঙ্গে এসোতো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। তিনি কী বলবেন তা আমি জানি। কেন আমাকে বাদ দিতে হল তা ব্যাখ্যা করবেন। ব্যাখ্যাটা কী ভাবে করা হবে তা হচ্ছে কথা! নিশ্চয়ই খুব সুন্দর করে বলবেন।
একই কথা একেকজন একেক ভাবে বলে। শুধু মাত্র বলার ভঙ্গির কারণে কথার অর্থ পর্যন্ত বদলে যায়। ডিরেক্টর সাহেব আমাকে বলবেন— রুমালী! আমি খুব দুঃখিত যে তুমি বাদ পড়ে গেলে। ঘটনাটার উপর আমার হাত ছিল না। তোমার যত না খারাপ লাগছে, আমার তার চেয়েও বেশি খারাপ লাগছে। অভিনয় ভাল না হবার কারণে তুমি যদি বাদ পড়তে আমার মোটেও খারাপ লাগত না। অভিনয় তুমি যে শুধু ভাল কর তা না, খুবই ভাল কর। শোন রুমালী কিছু কিছু ঘটনা এই পৃথিবীতে ঘটে যার উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এই ব্যাপারটা বুদ্ধিমতী মেয়ে হিসেবে অবশ্যই তুমি জান। আমার অবস্থা তুমি সেই দিক থেকে বিচার করবে। কেমন? বি এ গুড গার্ল। এইবার সুন্দর করে একটু হাসোতো।
ডিক্টের সাহেব এর বাইরে কিছু বলবেন না। এইটিই তিনি হয়ত আরো গুছিয়ে বলবেন— আমার কাছে মনে হবে আরে তাইতো। মানুষটার উপর তখন আমার আর রাগ থাকবে না। মানুষটার জন্যে করুণা ও মমতায় হৃদয় দ্রবীভূত হবে।
উনি কীভাবে কথাগুলি বলেন তা শোনার জন্যে আগ্রহ নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি। উনি কিছু বলছেন না। উনি মানুষজন যে দিকে বসে আছে তার উল্টো দিকে যাচ্ছেন। মাঠের দিকে যাচ্ছেন। সবাই নিশ্চয়ই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সবাই ভাবছে–ব্যাপারটা কী?
রুমালী!
জ্বি।
তুমি আমাকে ছোট্ট একটা কাজ করে দাও তো।
কী কাজ বলুন— করে দিচ্ছি।
এই মাঠে কিছু ফড়িং ঘুরছে। তুমি আমাকে বড় সড় দেখে একটা ফড়িং ধরে দাও। ফড়িং ধরতে পার না?
কখনো ধরি নি। তবে নিশ্চয়ই ধরতে পারব।
ফড়িং দিয়ে কী করব বলতো?
দিলুর যখন শট নেয়া হবে তখন ফড়িংটা আপনি ব্যবহার করবেন। দিলুর হাতে থাকবে ফড়িংটা।
ঠিক ধরেছ। ক্যামেরা দিলুকে পেছন থেকে ধরবে। দেখা যাবে সে মাঠে ছোটাছুটি করছে। একটা হাতে তখন কিন্তু ফড়িংটা আছে। ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে না। আমরা ক্যামেরায় যা দেখছি তা হচ্ছে একটা মেয়ে মাঠে ছোটাছুটি করছে। মেয়েটা যখন ক্যামেরার দিকে ফিরে তাকাল তখন দেখা গেল তার হাতে ফড়িংটা ধরা। ফড়িংটা ছটফট করছে মেয়েটা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। ফড়িং এর দিকে। দৃশ্যটা সুন্দর হবে না?