মা জেগেই ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, এখনো যাস নি।
আমি বললাম, না। ডাক্তার তোমাকে কী বলল?
মা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ডাক্তার ছেলেটাকে দেখেছিস? কী রকম রাজপুত্রের মত চেহারা। কী অসম্ভব ভদ্র। এখনো বিয়ে করে নি।
এর মধ্যে সব জিজ্ঞেস করে ফেলেছ?
জিজ্ঞেস করতে অসুবিধা কী? ছেলের বাড়ি কোথায় বলতো?
সুন্দরবন?
সুন্দরবন বাড়ি হবে কেন? ওদের দেশের বাড়ি নেত্রকোনা কী রকম যোগাযোগ লক্ষ্য করেছিস? তোর বাবার দেশের বাড়িও নেত্রকোনা।
আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি। এতো পাগলের প্রলাপ! মা আনন্দিত গলায় বললেন— ছেলেটার ভাল নাম শাহেদুর রহমান। ডাকনাম মিঠু।
তোমাকে সে ডাকনামও বলে ফেলল?
নিজ থেকেতো বলে নি। জিজ্ঞেস করেছি বলেই বলেছে। তোকে সে দেখেছে। একদিন শুটিং এর সময় ছিল।
আমাকে পছন্দ করেছে?
তোকে অপছন্দ করবে কে? তোকে যেই দেখবে তারই মাথা ঘুরে যাবে।
মা শোন তুমি মিঠু বাবাজীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসো নিতো?
বাবাজী বলছিস কেন? এইসব আবর কী রকম ঢং? মিঠু বলেছে আমাদেরকে নিয়ে এখান থেকে এগারো কিলোমিটার দূরে একটা পাহাড় দেখতে যাবে। পাহাড় ভর্তি সুন্দর সুন্দর পাথর। মিঠুর ধারণা দামী পাথর।
মা তোমার বকবকানি অসহ্য লাগছে। আমি শুটিং-এ গেলাম। তুমি শুয়ে শুয়ে ডাক্তার ছেলেকে বড়শি দিয়ে খেলিয়ে ডাঙ্গায় তোলার নানা ফন্দি ফিকির বের করার চেষ্টা করতে থাক।
ঘর থেকে বের হয়েই আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশে মেঘ জমছে। বৃষ্টি হলে শুটিং বন্ধ হয়ে যাবে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম— বৃষ্টি যেন না হয়। চারদিকে যেন ঝলমল করে সূর্যের আলো। শুটিং যেন ঠিকমত হয়। মঈন নামের মানুষটা যেন তার কাজ সুন্দর মত গুছিয়ে শেষ করতে পারেন।
সেলিম ভাইয়ের একটা দৃশ্য
সেলিম ভাইয়ের একটা দৃশ্য দিয়ে শুটিং শুরু হবে।
গাছের নীচে বসে তিনি ক্যামেরার লেন্স পরিষ্কার করবেন। গ্রামের একটা ছেলে কৌতূহলী হয়ে দৃশ্যটা দেখবে। ছেলেটির দিকে না তাকিয়েই তিনি বলবেন— ছবি তুলবি? ছেলেটা না সূচক মাথা নাড়বে। তখন দূর থেকে দিলুর গলা শোনা যাবে। দিলু চেঁচিয়ে বলবে–আমার একটা ছবি তুলে দিন। আমার ছবি। সেলিম ভাই দিলুর দিকে তাকিয়ে হাসবেন। দিলু এসে দাঁড়াবে। তার ছবি তোলা হবে। তখন দিলু বলবে–এখন এই পিচ্চিটার পাশে একটা ছবি তুলব। বলেই সে ছেলেটার সঙ্গে দাড়িয়ে ছবি তুলবে। তারপর তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে ছুটে যাবে পুকুর ঘাটের দিকে। পুকুরের বাঁধানো ঘাটে তখন জামিল বসে আছেন। তাঁর হাতে একটা বই। পেঙ্গুইন পেপার ব্যাক। দিলু এসে জামিলের পাশে বসবে এবং বলবে, জামিল ভাই আমি আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলব। সেলিম ভাই ছবি তুলে দেবেন। জামিল বলবেন–যা ভাগ। দিলু আহত চোখে তাকিয়ে থাকবে জামিলের দিকে। জামিল তার আহত অভিমানী দৃষ্টি বুঝতে পারবেন না কারণ তিনি বই থেকে একবারও চোখ তোলেন নি। জামিল তখন বলবেন— দিলু যা তো কাউকে বল, আমাকে যেন কড়া করে এক কাপ চা দেয়। চিনি হাফ চামচ। দিলু উঠে দাঁড়াবে। তারপর একটা কান্ড করবে— জামিলের হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারবে পুকুরের দিকে। বই ছুঁড়ে ফেলেই দিলু ছুটে চলে যাচ্ছে। জামিল হতভম্ব। বইটা পুকুরের পানিতে ভাসছে। জামিল একবার তাকাচ্ছেন বইটার দিকে, একবার দিলুর দিকে। দিলুর ছুটে যাবার ব্যাপারটা সেলিমও দেখছেন। তিনি ক্যামেরা তুলে দিলুর ছুটে যাবার দৃশ্য নিয়ে নিলেন। শাটার টিপতেই ফ্রেমে বন্দি হল দিলু। সিকোয়েন্সের এইখানেই সমাপ্তি।
কাজ শুরু হচ্ছে না। তিথিকণার মেকাপ শেষ হয় নি। সে এসে পৌছায় নি। সর্পভুক সেলিম ভাই এসেছেন। তার গাল টাল ভেঙ্গে একাকার। শরীর মনে হয় পুরোপুরি সারে নি। কেমন উদভ্রান্ত দৃষ্টি। আমার দিকে যতবার চোখ পড়ছেচোখ ঝট করে ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কারণ বোঝা যাচ্ছে না। ডিরেক্টর সাহেব জাম গাছের নীচে বসে আছেন। তার পায়ের কাছে টুল। টুলে পা তোলা। বসার ভঙ্গি বেশ আয়েশী। সিগারেট টানছেন। সিগারেট টানতে টানতে গল্প করছেন। শ্রেতা মওলানা সাহেব। মওলানা গভীর আগ্রহে কথা শুনছেন। নিশ্চয়ই ধর্ম সংক্রান্ত কোন কথা।
সেলিম ভাই যে জায়গায় তার কাজ হবে ঠিক সেই জায়গাতেই বসা। তার পাশেই পিচ্চি ছেলেটা বসে আছে। ছেলেটাকে এখান থেকে নেয়া হয়েছে। গারো ছেলে। নাক চ্যাপ্টা বলে অন্য রকম সুন্দর। গায়ের রং ধবধবে শাদা। গারোদের মধ্যে কালো কম। সেলিম ভাই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছেন। ছেলেটা কথা বলছে না, শুধু শুনে যাচ্ছে। তাদের কারো কথাই আমি শুনতে পাচ্ছি না। আমার কান খুব পরিষ্কার। অন্য সময় হলে তাদের কথা শুনতে পেতাম–আজ পাচ্ছি না। আজ আমার মন অন্য রকম হয়ে আছে। সেই অন্য রকমটা কী নিজেও বুঝতে পারছি না।
পাপিয়া ম্যাডাম তাঁর মেয়ের সঙ্গে কী একটা খেলা খেলছেন। কোন ইলেকট্রনিক গেম হবে। লুডু বোর্ডের মত বোর্ড। সাপ এবং মইয়ের ছবি আছে। তবে কৌটায় ছক্কা নিয়ে চলতে হয় না। চালার বদলে বোতাম টিপতে হয়। বোতাম টিপলেই শুরুতে মেরী হ্যান্ড আ লিটল ল্যাম্বের বাজনা বাজে তারপর এক থেকে ছয়ের ভেতর একটা সংখ্যা ভেসে ওঠে।
বোতাম টেপার ফাঁকে ফাঁকে পাপিয়া ম্যাডাম আমার সঙ্গে কথা বলছেন। খুব সাধারণ কথা। কথা বলতে হয় বলেই বলা। মেয়ে সঙ্গে আছে বলে তিনি অন্য সবার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন এ রকম হতে পারে।