জ্বি না।
শোন রুমালী আমি কথা খুব কম বলি। আবার মাঝে মাঝে যখন মেজাজ খারাপ হয় তখন প্রচুর কথা বলি। প্রচুর কথা বলায় আমার নিজের লাভের মধ্যে লাভ এই হয়— যার সঙ্গে কথা বলি সে যায় রেগে।
আমি রাগি নি, রাগ করার মত কোন কথা আপনি বলেন নি।
এখন বলব–কথাটা হচ্ছে–তুমি আমার পেছনে পেছনে ঘুর ঘুর করবে। বড় জাহাজের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছোট্ট একটা নৌকা থাকে। জাহাজ যেখানে যায় নৌকা জাহাজের পেছনে পেছনে সেখানে যায়। এই নৌকাকে বলে গাধাবোট। আমি জাহাজ কি না জানি না, কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি— আমার সঙ্গে সব সময় চার পাঁচটা গাধাবোট থাকে। গাধাবোট আমার কাছে অসহ্য লাগে।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাপিয়া ম্যাডাম এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর শেষ কথাগুলিতে আমি কী রকম কষ্ট পেলাম তা দেখার জন্যেও একবার পেছনে ফিরলেন না। মজার ব্যাপার হল আমি একেবারেই কষ্ট পাই নি। বরং আমার একটু হাসি পাচ্ছে। কাউকে কষ্ট দেব এটা আগে ভাগে ঠিক করে কেউ যখন কিছু করে তখন আর কষ্ট লাগে না! আরেকটা ব্যাপার হতে পারে মার সঙ্গে থেকে থেকে আমার গায়ের চামড়াও হয়ত খানিকটা শক্ত হয়েছে।
বকুল শুনে যাও।
আমি পেছন ফিরলাম। ডিরেক্টর সাহেব আমাকে ডাকছেন। তিনি বেশ আয়েশ করে বসেছেন। পাপিয়া ম্যাডাম যে চেয়ারে বসেছিলেন সেই চেয়ারে পা তুলে দিয়েছেন। এতক্ষণ চোখে সানগ্লাস ছিল না, এখন চোখে সানগ্লাস। পাপিয়া ম্যাডামের ফেলে যাওয়া সানগ্লাসটাই তার চোখে। তার মুখ আকাশের দিকে ফেরানো। গা এলানো গা এলানো ভাব।
ক্রেন ট্রলীতে কোন একটা সমস্যা হচ্ছে। ট্রলী খোলা হচ্ছে। মনে হয় সমস্যা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত শুটিং শুরু হবে না।
আমি ডিরেক্টর সাহেবের পাশে এসে দাঁড়াতেই তিনি চেয়ার থেকে পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, বোস। আমি বসলাম।
তুমি কেমন আছ?
জি ভাল।
চন্ডিগড় জায়গাটা সুন্দর না?
জ্বি।
আমার কাছে তত সুন্দর লাগছে না। আমার মনে হচ্ছে আউটডোর বান্দরবানে ফেললে ভাল হত। তুমি বান্দরবানে কখনো গিয়েছ?
জ্বি না।
খুব সুন্দর। একটা পাহাড়ি নদী আছে। নদীর নাম–শংখ নদী। খুব সুন্দর।
ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে আমার ভাল লাগছে না। কারণ তিনি সানগ্লাস পরে আছেন। সানগ্লাস পরা মানুষ কোন দিকে তাকিয়ে আছে তা বোঝা যায় না বলে কথা বলে ভাল লাগে না। তা ছাড়া ডিরেক্টর সাহেবও আমার সঙ্গে দায়সারা ভাবে কথা বলছেন। এই মুহুর্তে তাঁর কিছু করার নেই বলেই কথা বলে সময় কাটানো। কথা বলার জন্যে তার সবসময় কাউকে না কাউকে দরকার। পাপিয়া ম্যাডাম নেই কাজেই আমাকে দরকার। আমি না থাকলে তিনি অন্য কাউকে ডেকে নিতেন। ফিল আপ দ্যা ব্ল্যাংক। শূন্যস্থান পূরণ।
বকুল!
জ্বি।
দেখি একটা প্রশ্নের জবাব দাও–তোমার বুদ্ধি কেমন পরীক্ষা করা যাক। ব্যাপারটা হচ্ছে কী–তিনটা পিঁপড়া সারি বেঁধে যাচ্ছে। একজনের পেছনে একজন। সবার প্রথম যে পিঁপড়াটা যাচ্ছে সে বলল, আমার পেছনে আছে দুটা পিঁপড়া। মাঝখানের পিঁপড়াটা বলল, আমার সামনে আছে একটা পিঁপড়া, পেছনে আছে একটা পিঁপড়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে সবচে পেছনে যে পিঁপড়াটা যাচ্ছে সে বলল–আমার সামনে কোন পিঁপড়া নেই, আমার পেছনে আছে দুটা পিঁপড়া। সে এ রকম বলছে কেন?
আমি চুপ করে রইলাম। এই ধাঁধার উত্তর আমি জানি। এর উত্তর হচ্ছে–সবচে পেছনের পিঁপড়াটা চালবাজ এবং মিথ্যুক। সে মিথ্যা কথা বলছে। কেউ যদি ধাঁধা জিজ্ঞেস করে তার মনে মনে আশা থাকে ধাঁধার জবাব কেউ পারবে। যদি কেউ পেরে যায় তাহলে প্রশ্নকর্তার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি ডিরেক্টর সাহেবের মন খারাপ করতে চাইলাম না। আমি এমন ভাব করলাম যে, আঁধার জবাব আমার জানা নেই। আমি আকাশ পাতাল ভাবছি। ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছি না।
পারছ না?
পারব। আমার একটু সময় লাগবে।
কোন অসুবিধা নেই। সময় নাও। যত ইচ্ছা সময় নাও।
আচ্ছা পিঁপড়া তিনটা কি আসলেই একটার পর একটা যাচ্ছিল?
অবশ্যই।
এরা হঠাৎ উল্টো দিকে চলা শুরু করে নিতো?
না।
আমি পারছি না।
পারছ না? খুব সহজ, শেষের পিঁপড়াটা দারুণ মিথ্যুক। সে মিথ্যা কথা বলছিল। মানুষের মধ্যে যেমন মিথ্যুক আছে পিঁপড়াদের মধ্যেও আছে। হা হা হা।
ডিরেক্টর সাহেব উচ্চ স্বরে হাসতে লাগলেন। উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখে পানি এসে গেল। হঠাৎ করেই এসে গেল। উনি ভাবলেন—ধাঁধার জবাব দিতে না পারার কারণে লজ্জায় এবং অপমানে আমার চোখে পানি এসেছে। তিনি খুবই অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।
আরে বোকা মেয়ে কাঁদছ কেন? এটা একটা ফালতু ধরনের ধাঁধা। তোমাকে জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়েছে। আচ্ছা যাও প্রতিজ্ঞা করছি—এই জীবনে তোমাকে আর ধাঁধা জিজ্ঞেস করব না। প্লীজ চোখ মোছ।
আমি উড়নায় চোখ মুছলাম।
যাও রেস্ট হাউসে চলে যাও। বিশ্রাম কর। গল্পের বই-টই পড়। আজ তোমার কোন কাজ হবে না। আর শোন মেয়ে একটা কথা বলি——কিছু না পারলেই কেঁদে ফেলতে হবে এটা ঠিক না। তুমি তোমার এক জীবনে দেখবে অনেক কিছুই পারছ না। প্রতিবারই যদি কাঁদতে থাক তাহলে তোমার জীবন যাবে কাঁদতে কাঁদতে। এটা ঠিক না।
আমি চলে যাচ্ছি। ডিরেক্টর সাহেব এখন যদি আমাকে দেখতেন——তাহলে অবাক হতেন। আমার চোখ শুকনা এবং ঠোঁটে হাসি। বিষাদের হাসি না, আনন্দের হাসি। হঠাৎ এত আনন্দ হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। আমার নিজের অনেক কিছুই আমি এখন বুঝতে পারি না। শিমুল গাছের নীচে আমি দীর্ঘসময় দাঁড়িয়েছিলাম। কেন দাঁড়িয়েছিলাম? শুটিং দেখার জন্যে? কাজ শেখার জন্যে?, তা না। আমি দাঁড়িয়েছিলাম যাতে ডিরেক্টর সাহেবকে দেখতে পাই। এই মানুষটাকে আমার এক মুহূর্তের জন্যে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করে না। তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই আমার চোখে পানি আসে। এর মানেই বা কী? ভয়ংকর একটা ঘটনা আমার ভেতর ঘটে গেছে। কেন ঘটল, কীভাবে ঘটল, আমি জানি না। আমার জানতে ইচ্ছে করে না। এই ভদ্রলোক আজ যদি আমাকে ডেকে বলেন—বকুল শোন, তুমি একটা কাজ কর। আমি একটা মৃত্যু দৃশ্যের শট নেব। তুমি ঐ যে পাহাড়টা দেখা যায়–পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ঝাপ দিয়ে নীচে পড়।