থ্যাংক য়্যু।
সোহরাব চাচা চলে গেলেন। এতক্ষণে শুটিং শুরু হল। তিনটা টেক নেয়া হল। টেক মনে হয় ভাল হয়েছে। ডিরেক্টর সাহেবকে খুশি খুশি দেখাচ্ছে। তিনি সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিচ্ছেন। আনন্দের সময় তিনি ফস করে সিগারেট ধরান–লম্বা লম্বা কয়েকটা টান দিয়ে জ্বলন্ত সিগারেট দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেন। সেই সিগারেট কুড়িয়ে তুলে নেবার ব্যাপারে সমবেত জনতার মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ দেখা যায়। এখানেও তাই হচ্ছে।
মুখভর্তি চাপদাড়ির মওলানা ধরনের একজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম।
ভদ্রলোকের কাধে চাদর। পাঞ্জাবি নেমে এসেছে পায়ের পাতা পর্যন্ত। পাঞ্জাবির উপর খোপখোপ প্রিন্টের চাদর গা থেকে আতরের গন্ধ ভেসে আসছে। ভদ্রলোকের দিকে ভাল মত তাকালে দেখা যাবে চোখে সুরমাও দিয়েছেন। আমি ভাল মত তাকালাম না। এই জাতীয় মানুষরা কঠিন প্রকৃতির হয়ে থাকেন। শুটিং নিয়ে অকারণ হৈ চৈ শুরু করে দিতে পারেন। হয়ত বলে বসবেন আজ জুম্মাবার—আজ এইসব কী হচ্ছে? ঢাকার আশে পাশের মানুষ শুটিং-এ অভ্যস্ত। জায়গাটা ঢাকা থেকে অনেক দূরে। ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা। সেখান থেকে দুর্গাপুর। দুর্গাপুর থেকে আরো তিন কিলোমিটার। জায়গাটার নাম চন্ডিগড়। কে জানে হয়ত চন্ডিগড়ের মানুষরা খুব ধর্মভীরু।
এত জায়গা থাকতে চন্ডিগড়ে শুটিং হচ্ছে। কারণ চিত্রনাট্য এই ভাবে লেখা। ঢাকা থেকে গারো পাহাড়ের দেশ দুর্গাপুরে বেড়াতে এসেছে একটা পরিবার, রিটায়ার্ড পুলিশের বড় কর্তা এবং তাঁর দুই মেয়ে দিলশাদ ও নিশাত। ছুটি কাটানোর গল্প। তারা উঠল একটা ডাক বাংলোয় অনেক মজা করল। আমি হচ্ছি ছোট বোন দিলু।
মওলানা সাহেব বিনীত গলায় বললেন, আসসালামু আলায়কুম।
আমি খুবই অস্বস্থিতে পড়ে গেলাম। বয়স্ক কোন ভদ্রলোক আগ বাড়িয়ে সালাম দিলে খুব অস্বস্থি লাগে। আমি লজ্জিত গলায় বললাম, ওয়ালাইকুম সালাম।
শুটিং হচ্ছে নাকি মা?
জ্বি।
দাঁড়ায়ে যদি দেখি কোন অসুবিধা আছে?
জ্বি না।
কেউ কিছু বলবে নাতো?
জি না।
আপনি কি শুটিং এর মেয়ে?
জ্বি।
শুটিং এর কথা শুধু শুনেছি। দেখার সৌভাগ্য হয় নাই।
আজ দেখুন।
রাংতা লাগানো বোর্ডের মত জিনিসগুলি কী?
এদেরকে বলে রিফ্লেক্টর। আয়নার মত। গায়ের উপর আলো ফেলে।
বাহ্ চমৎকার। লাল সার্ট পরা ভদ্রলোক কে?
উনি মঈন খান এই ছবির পরিচালক। ছবিটা উনি বানাচ্ছেন।
আলহামদুলিল্লাহ। উনার সঙ্গে কি কথা বলা যাবে?
কেন যাবে না–অবশ্যই যাবে। তবে এখন কাজ করছেনতো এখন বিরক্ত ন করাই ভাল।
জি আচ্ছা। জ্বি আচ্ছা। বিরক্ত করব না। মঈন সাহেবের স্ত্রী মাশাল্লাহ দেখতে খুব সুন্দর।
উনি ডিরেক্টর সাহেবের স্ত্রী না। উনার নাম পাপিয়া —এই ছবির নায়িকা। খুব বড় অভিনেত্রী।
ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেল। পাপিয়া ম্যাডাম যেভাবে বসেছেন তাতে যে কোন মানুষেরই ভুরু কুঁচকাবার কথা। দুটা চেয়ার গায়ে গায়ে লেগে আছে। পাপিয়া ম্যাডাম ভঁর বাঁ হাত পাশের চেয়ারের হাতলে তুলে দিয়েছেন। দূর থেকে মনে হয় তিনি ডিরেক্টর সাহেবের কাধে হাত রেখে বসে আছেন।
কড়া রোদ উঠেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ। সকালবেলা ঠান্ডা থাকে। কুয়াশা কুয়াশা ভাব থাকে। এগারোটার দিকে ঝাঁঝালো রোদ উঠে যায়। এমন রোদ যে চোখ জ্বালা করতে থাকে।
মা শুটিং কি শেষ হয়ে গেছে?
জ্বি না— আজ সারাদিনই শুটিং হবে।
ঐ যন্ত্রটা কী?
এর নাম ক্রেন ট্ৰলী। ক্যামেরা ক্রেন ট্রলীতে বসিয়ে উপুর নিচ করা হয়। আপনি দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুটিং দেখুন আমি চলে যাচ্ছি।
আমি চন্ডিগড় হাইস্কুলের শিক্ষক—ইসলামিয়াত পড়াই।
ও আচ্ছা। খুব ভাল।
আমিও চলে যাব—আজ জুম্মাবার নামাজ আছে। আমার নাম মেরাজ উল্লাহ্। লোকে অবশ্য মেরাজ মাস্টার ডাকে। আমি আরো কিছুক্ষণ দেখি— আযান হয় বারোটার সময়। বারোটা বাজতে এখনো দেরি আছে।
আপনার যতক্ষণ ইচ্ছা দেখুন।
মা আপনার নামটা জানা হয় নাই।
আমার নাম বকুল।
মাশাল্লাহ অতি সুন্দর নাম।
আমি জায়গা ছেড়ে চলে এলাম—মেরাজ মাস্টার সাহেব আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে গভীর আগ্রহে চারপাশের কর্মকান্ড দেখছেন। আজ আমার কোন সিকোয়েন্স হবে না। সাব্বিরের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করবেন তিনি এসে পৌছান নি, তাঁর গতকালই এসে পৌঁছানোর কথা। তাঁকে ছাড়া শুটিং শুরু করা যাচ্ছে না। ভদ্রলোক সবাইকে খুব বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন। তবে ডিরেক্টর সাহেবের মধ্যে এ নিয়ে কোন দুঃশ্চিন্তা লক্ষ্য করছি না। কোন কিছু নিয়েই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ না হবার ক্ষমতা এই মানুষটার আছে। কেমন গা এলিয়ে সিগারেট টানছেন যেন মনে হচ্ছে তিনিই রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছুটি কাটাতে স্বয়ং দুর্গাপুরের পাহাড়ে এসেছেন। ছুটি শুরু হয়েছে।
পাপিয়া ম্যাডামের দিকে চোখ পড়তেই দেখি তিনি হাত উঁচিয়ে আমাকে ডাকছেন। আমি চাপা অস্বস্তি নিয়ে এগুচ্ছি। এই মহিলার সামনে কেন জানি আমি কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারি না। পাপিয়া ম্যাডাম গলায় লাল পাথরের নেকলেস পরেছেন। শিমুল ফুলের মত পাথরগুলিও জ্বলছে। তার চোখে এখন সানগ্লাস। কিছুক্ষণ আগেও সানগ্লাস ছিল না। তাঁকেতো সারাক্ষণই লক্ষ্য করছি। কোন ফাঁকে সানগ্লাস পরে ফেললেন? পাপিয়া ম্যাডামের সামনে দাঁড়ানোর পর আমার প্রথম যে ইচ্ছাটা হল তা হচ্ছে আমি অবিকল উনার মত একটা লাল পাথর বসানো নেকলেস কিনব।