বিনীতা
মালিহা রুমালীর দুর্ভাগা মাতা
সাবিহা বেগম মুক্তা।
মার এই জাতীয় দরখাস্তে কাজ হত। তিনি নানান ধরনের মহিলা সমিতিতেও ঘুরতেন। এক মহিলা সমিতি তাঁকে পায়ে চালানো একটি সেলাই মেশিন দিয়েছিল। তিনি মেশিন বিক্রি করে সেই টাকাও ব্যাংকে জমা করে রেখেছিলেন। এক এনজিওর কাছ থেকে তিনি আমার জন্যে একটা বৃত্তিও জোগাড় করেন। মাসে পাঁচশ টাকা। এই টাকা নেবার জন্যে প্রতি মাসের তিন তারিখে আমাকে মার সঙ্গে এনজিওর অফিসে যেতে হত এবং দীর্ঘ সময় করুণ মুখ করে একটা ঘরে বসে গরমে ঘামতে হত। সেই ঘরে ফ্যান ছিল, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার বনবন করে ফ্যান ঘুরলেও সেই ফ্যানে কোন বাতাস হত না।
মার ভিক্ষাবৃত্তিমূলক কর্মকান্ড শুরুতে অসহ্য লাগলেও শেষে সয়ে গিয়েছিল। মানুষের দয়া এবং করুণা পাবার নিত্য নতুন কলাকৌশল মা আবিষ্কার করতেন–আমি সে সব দেখতাম, এবং অবাক হতাম। মার কারণেই আমি প্রথম টিভি নাটকে সুযোগ পেলাম। নাটকের প্রযোজকের বাসার ঠিকানা বের করে তিনি একদিন আমাকে নিয়ে তাঁর বাসায় উপস্থিত। প্রযোজকের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তিনি নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলতে বলতে যে কান্না শুরু করলেন—সেই কান্নায় পাথর গলে প্রযোজকের স্ত্রীতো গলবেনই। ভদ্রমহিলাও চোখ মুছতে লাগলেন। সেই মহিলার কল্যাণে আমি জীবনে প্রথম ক্যামেরার সামনে নড়ালাম। নাটকের নাম স্বপ্ন সায়র। স্বপ্ন সায়র নাটকে আমার অভিনয় নিশ্চয়ই খুব ভাল হয়েছিল— কারণ আমার মাকে তারপর আর কখনো কোন প্রযোজকের বাসায় গিয়ে তাদের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে হয় নি। বছরের শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী হিসেবে আমি দুবার রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেলাম। আমাদের বসার ঘরে দুটা ছবি বড় করে বাঁধাই করা আছে। একটাতে আমি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেবের হাত থেকে পদক নিচ্ছি, অন্যটায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের হাত থেকে পদক নিচ্ছি। এরশাদ সাহেবের একটা হাত আমার মাথায় রাখা। মা আমাকে গান শেখার ব্যবস্থা করলেন, নাচ শেখার ব্যবস্থা করলেন, সবই বিনা পয়সায়। একজন স্বামী পরিত্যক্তা আশ্রয়হীনা মহিলার প্রতি দয়া বশতই গানের এবং নাচের টিচার রাজি হলেন।
সোহরাব চাচা আমার দিকে আসছেন। তার হাতে বড় একটা কাচের গ্লাস। সোহরাব চাচা হচ্ছেন কথাকলি ফিল্মসের প্রডাকশন ম্যানেজার। রোগা টিং টিং-এ একজন মানুষ। সব সময় হলুদ পাঞ্জাবি পরেন এবং ক্রমাগত পান খান। ভাত খাবার আগেও তাঁর মুখ ভর্তি পান থাকে। ভাতের নলা মাখার সময় থু করে পান ফেলে কুলি করে নেন। অসাধারণ একজন মানুষ। মাছির যেমন হাজার হাজার চোখ থাকে তারও তেমনি হাজার হাজার চোখ। চারপাশে কোথায় কী হচ্ছে তিনি সব জানেন। সমস্যা, তা যত জটিলই হোক— তাঁর কাছে সমাধান আছে। সমস্যার সমাধান তিনি এমন ভাবে করেন যে কেউ বুঝতেই পারে না—সমাধানটা তিনি করেছেন। রাগ বলে কোন বস্তু তার ভেতর নেই। চব্বিশ ঘন্টা কাজ করতে পারেন। তবে কাজের ফাঁকে গল্প করতেও খুব পছন্দ করেন। বিশেষ বিশেষ মানুষের সঙ্গে যে গল্প করেন তা না— সবার সঙ্গে গল্প। যার সঙ্গে গল্প করেন মনে হয় সেই তার প্রাণের বন্ধু, তিনি আমাকে ডাকেন রুমাল।
রুমালের খবর কী?
খবর ভাল। আপনি কেমন আছেন চাচা?
আমি খুবই ভাল আছি— এই নাও তোমার বেলের সরবত।
বেলের সরবততে আমি খাব না।
সেকি তোমার মা যে বলল তুমি বেলের সরবত খেতে চাচ্ছ?
চাচ্ছি না।
আচ্ছা না চাইলেও খেয়ে ফেল। জিনিসটা ভাল। আরেকটা কথা শোন—যদি কিছু খেতে ইচ্ছে করে আমাকে বলবে! পুরোদস্তুর নায়িকা যখন হবে তখন আর বলতে হবে না। আপনাতেই সব হয়ে যাবে।
চাচা আমি কি নায়িকা হতে পারব?
সেটা আমি বলতে পারব না। অভিনয় প্রতিভা কার কেমন তা জানি না, বুঝিও না। আমি হলাম যোগানদার। যার যা লাগবে—আমাকে বলবে আমি উপস্থিত করব।
আপনাকে যা আনতে বলা হবে নিয়ে আসবেন?
তুমি বললে আনব না। তবে ডিরেক্টর সাহেব বললে জোগাড় করব।
উনি যা বলবেন তাই এনে দেবেন?
এনে দেব। ফিল্ম লাইনের প্রডাকশন ম্যানেজার হতে হলে চাহিবা মাত্র উপস্থিত বিদ্যায় পারদর্শী হতে হয়। তবে শোন মিস রুমাল— উদ্ভট কিছু কোন ডিরেক্টর চায় না। ডিরেক্টরও জানে কী জোগাড় করা যাবে কী যাবে না।
মঈন সাহেবকে আপনি খুব পছন্দ করেন তাই না চাচা?
হ্যাঁ।
কেন করেন?
তুমি যে কারণে কর–আমিও সেই কারণে করি।
কই আমিতো পছন্দ করি না।
পছন্দ না করাই ভাল। বেলের সরবতটা কেমন লাগলগো মা?
ভাল।
রেসিপি লাগবে? রেসিপি লাগলে বল–আমি রেসিপি দিয়ে দিচ্ছি। কাগজে লেখা আছে। এই নাও।
আমি অবাক হয়ে দেখি সত্যি একটা কাগজে-বেলের সরবতের রেসিপি লেখা। সোহরাব চাচার হাত থেকে আমি কাগজটা নিলাম—
বেলের সরবত
পাকা বেল ১টি
ঠাণ্ডা পানি ৩ কাপ
দৈ ১/২ কাপ
চিনি ১ কাপ
গোলাপজল ১ টেবিল চামচ
১. বেলের আঠা ও বীচি ফেলে ১ কাপ পানিতে ভেজাতে হবে মোটা চালুনীতে ছেঁকে নিতে হবে।
২. চালবার পর ১ কাপ চিনি মেশাতে হবে।
৩. দৈ ফেটে মেশাতে হবে। গোলাপ জল এবং বরফের কুচি দিয়ে পরিবেশন করতে হবে। চিনির বদলে ক্যারামেল সিরাপ দেয়া যেতে পারে।
আমি বললাম, চাচা আপনি রেসিপি নিয়ে ঘুরছেন কেন?
সোহরাব চাচা গলার স্বর নিচু করে বললেন, পাপিয়া ম্যাডামের জন্যে। ম্যাডামের এই সরবত এত পছন্দ হয়েছে যে রেসিপি চেয়েছেন। রেসিপি যখন লিখতেই হচ্ছে কার্বন পেপার দিয়ে তিন কপি করে ফেললাম–ছোট নায়িকা হিসেবে তুমি এক কপি রেখে দাও।