ভাড়াটে গুন্ডার পরিকল্পনা এক সময় বাতিল হয়— মা বিপুল উৎসাহে উকিলের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। দিনে উকিলের সঙ্গে কথা রাতে আমার সঙ্গে পরামর্শ বুঝলি বকু হুজুরকে আমি শ্রীঘরে নিয়ে ছাড়ব। আমার বিনা অনুমতিতে বিয়ে! সাত বৎসর শ্রীঘরে বসে ইট ভাঙ্গতে হবে। ইট ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে হাতে কড়া পড়ে যাবে। আমি সহজ জিনিস না। তুই শুধু দেখ— কী হয়।
শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। মা কাঁদতে কাঁদতে আগামসি লেনে তার বাবা-মার সঙ্গে থাকতে আসেন। আর আমার বাবা তার অফিস সেক্রেটারীকে বিয়ে করে ফেলেন। আমার ধারণা তাদের এখন বেশ সুখের সংসার। দুটা ছেলেমেয়ে আছে। বাবা থাকেন এলিফেন্ট রোড়ে একটা কেনা ফ্ল্যাটে। তাদের একটা মেরুন কালারের গাড়িও আছে। একদিন দেখি নতুন মা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। বাবা তার পাশে বসে হাসি হাসি মুখে কী যেন বলছেন। নতুন মার মুখেও হাসি। বাবা বেশ সুখেই আছেন। তবে মার ধারণা বাবা আছেন হাবিয়া দোজখে। কারণ যে মহিলাকে বিয়ে করেছেন—তিনি পর্বতের মত। বসলে উঠে দাঁড়াতে পারেন না। টেনে তুলতে হয়।
বুঝলি বকু, সারা গায়ে শুধু থলথলা চর্বি। পুতুল পুতুল দেখে তোর বাবা মজে গিয়ে বিয়ে করেছিল–সেই পুতুল এখন মৈনাক পর্বত। ট্রাকে তুললে ট্রাকের চাকার হাওয়া চলে যায় এই অবস্থা। আর মাগীর মেজাজ কী! সারাক্ষণ খ্যাক খ্যাক করে।
সবই মার বানানো কথা। মহিলা একটু মোটার দিকে। কিন্তু খুবই মায়াকাড়া চেহারা। মৃদুভাষি। কথা বলার সময় ঠোঁট টিপে টিপে হাসেন— দেখতে ভাল লাগে। আমার সঙ্গে তাঁর এই পর্যন্ত তিনবার দেখা হয়েছে। তিনবারই তিনি খুব ভদ্র ব্যবহার করেছেন। আমাদের এই দেখা হবার খবর জানেন না। খবর জানলে আবারো গোলাপ ফুলে দেয়ার কীটনাশক অষুধ খেয়ে ফেলতেন।
তবে এখন আর আমাদের গোলাপ গাছ নেই। এবং গাছে দেয়ার অষুধও নেই। নাজানের দোতলা বাড়ির একটা অংশে আমরা থাকি। দোতলার অর্ধেকটা এবং একতলার পুরোটা ভাড়া দেয়া হয়। এই ভাড়ার টাকায় আমাদের এবং আমার মামার সংসার চলে। মামার বয়স পঞ্চাশ-— এখনো বিয়ে করেন নি। আমার বুদ্ধি হবার পর থেকে শুনে আসছি তিনি বিয়ে করছেন। সব ঠিকঠাক। সেই বিয়ে এখনো হয় নি। এতে অবশ্যি আমার মা খুশি। কারণ বিয়ে কলেই দোতলার অর্ধেকটা আর ভাড়া দেয়া যাবে না। মামা সেখানে তাঁর সংসার পাতবেন। বাড়ি ভাড়া থেকে আয় অর্ধেক হয়ে যাবে। সংসারের খরচও যাবে বেড়ে। মামাকে তখন আর সামান্য হাত খরচ দিয়ে মানানো যাবে না। নিতেই মামা কিছুদিন পর পর গম্ভীর গলায় মাকে ডেকে বলেন–সাবিহা শোন তোর ভালর জন্যে বলছি। তোর মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। এখন দেখে নে একটা বিয়ে দিয়ে দে। তারপর তুই মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতে উঠে যা। বরণ এই বাড়ি আমার। বাড়ি ভেঙ্গে আমি ফ্লাট বানাব। এক তলায় দোকান, উপরে ফ্লাট। মুফতে অনেক দিন থেকে গেলি। তোর কাছে থেকে এক পয়সা ড়ি ভাড়া নেই নি। আর কত? সারাজীবন তোদের পালব এমন কথাতো না। মতো আর হাজি মোহাম্মদ মোহসিন না। আমি হলাম গিয়ে পাজি মোহাম্মদ কাসেম।
নানাজানের এই বাড়ি যে শুধু মামার একার তা না। মার অবশ্যই তাতে অংশ আছে। মা মামার সঙ্গে ঐ লাইনে কোন কথা বলেন না। মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন-ভাইজান এই বাড়ি অবশ্যই আপনার। আপনি যেদিন বলবেন সেদিনই চলে যাব। আজ বললে আজ যাব। বিপদের সময় আপনি যে আমাকে থাকতে দিয়েছেন এই যথেষ্ট। আমার আর আমার মেয়ের চামড়া দিয়ে জুতা। নালেও আপনার ঋণ শোধ হবে না ভাইজান। ……
বলতে বলতে মার গলা ধরে যেত, তিনি বাক্য শেষ করতে না পেরে কেঁদে অস্থির হতেন। এতেই আমার কাসেম মামা বিচলিত হয়ে বলতেন—আরে কী শুরু করলি? তোদের আমি ফেলে দেব নাকি? আমার একটা বিচার আছে না? আমিতো নর-পিশাচ না। আমি নর-মানব। আমি যতদিন থাকব তোরাও থাকবি। চোখ মুছ।
চোখ মোছার বদলে মা আরো ব্যাকুল হয়ে কেঁদে উঠতেন। মামা হতেন চেলিত আমি আমার মায়ের অভিনয় প্রতিভায় হতাম মুগ্ধ।
মা অবশ্যই বুদ্ধিমতী। বাবার চলে যাওয়াকে এক সময় তিনি সহজ ভাবে নিয়ে নিলেন এবং বাস্তব স্বীকার করে বাঁচার চেষ্টা চালালেন। বাবার কাছে কান্নাকাটি করে তিনি মাসিক একটা বরাদ্দের ব্যবস্থা করলেন। এ ছাড়াও প্রায়ই বকুলের শরীর খারাপ চিকিৎসা করাতে হবে, বকুলের কলেজে ভর্তি হবার খরচ, এইসব বলে বলে টাকা আদায় করতে লাগলেন। সেই টাকার একটা পয়সাও খরচ করলেন না। ব্যাংকে জমা করতে লাগলেন। বাড়ি ভাড়া বাবদ যে টাকা পেতেন তার পুরোটাও মা খরচ করতেন না। একটা অংশ ব্যাংকে জমা করতেন। ছোটাছুটি করার ব্যাপারে মা একজন এক্সপার্ট। নিজের জীবনের দুঃখের কাহিনী বলার ব্যাপারেও এক্সপার্ট। স্কুলে আমাকে কখনো বেতন দিতে হয় নি। ফ্রী শিপের জন্যে মা দরখাস্ত করতেন। যেখানে লেখা থাকত–
আমি স্বামী পরিত্যক্ত একজন মহিলা বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছি। আমার বর্তমানে কোন সহায় সম্বল নাই, আশ্রয় নাই। দুইবেলা অন্ন সংস্থানের পথ নাই। আমি তারপরও মানুষের মত বেঁচে থাকতে চাই। তার পরেও আমি আমার কন্যা মালিহা রুমালীকে (বকুল) সুশিক্ষিত করতে চাই। আমার এই কন্যা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে তৃতীয় স্থান দখল করেছিল। অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় সে মেধা তালিকায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হয়েছিল। আপনার দয়ার উপর আমি নির্ভর করছি। এই কঠিন জীবন সংগ্রামে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। মালিহা রুমালীর বৃত্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের খবর পত্রিকায় ছাপা হয়। আপনার অবগতির জন্যে পেপার কার্টিং এর ফটোকপি পাঠাইলাম।