বাচ্চা দুটি পুকুর থেকে উঠে এসেছে বলে তাদের গা ভেজা থাকার কথা। রোদে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের গা শুকিয়ে যাচ্ছে। তখন তাদের মাথায় বালতি ভর্তি পানি ঢালা হচ্ছে। এই কাজটিতে এরা দুজনই খুব মজা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে তাদের জীবনে এমন আনন্দময় মুহূর্ত আর আসে নি।
আমি লক্ষ্য করলাম মা ছুটতে ছুটতে যাচ্ছেন। আমি মার মুখ দেখতে পাচ্ছি না–কিন্তু আমি জানি তার মুখ ভর্তি হাসি।
আজকের পরিস্থিতি মোটেই ভাল না। এখনো ক্যামেরা ওপেন হয় নি। এই অবস্থায় মা গিয়ে কী না কী বলবে কে জানে! তাদের কথাবার্তা এরকম হতে পারে। মা বলবেন, মঈন ভাই আমাদের কাজ কেমন হচ্ছে? (আপনার কাজ কেমন হচ্ছে, না-জিজ্ঞেস করে মা বলবেন—–আমাদের কাজ কেমন হচ্ছে। মা প্রমাণ করতে চাইবেন যে উনার কাজটাকে মা নিজের কাজ ভাবছেন।)
মঈন সাহেব মার কথার জবাবে কোন কথা বলবেন না, একটু হয়ত হাসবেন। মেজাজ ভাল থাকলে অবশ্যি মার সঙ্গে রসিকতা করে কিছু বলবেন। আজ মেজাজ ভাল নেই। মা তা ধরতে পারবেন না। কারণ মা অন্যের মেজাজ মর্জি কিচ্ছু বুঝতে পারেন না। নিজের মনে ছড়বড় করে কথা বলে যান।
আমার ধারণা মা এক পর্যায়ে বলবেন—মঈন ভাই, আমার মেয়ে আপনাকে কী চোখে যে দেখে–আপনি যা বলেন তাই তার কাছে একমাত্র সত্য? আপনি তাকে কাজ দেখতে বলেছেন–ঐ দেখুন সে রোদে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি তাকে ছায়ায় দাঁড়াতে বলুনতো। আপনি না বললে যাবে না। আশ্চর্য মেয়ে। কী সমস্যায় যে ভাই মেয়েটাকে নিয়ে আছি।
মঈন সাহেব তখন ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাবেন। কী হচ্ছে বুঝতে চেষ্টা করবেন। তিনি বলে ফেলতে পারেন–কই আপনার মেয়ের সঙ্গেতো আজ আমার কোন কথা হয় নি। তখন অবস্থাটা কী হবে! ডিরেক্টর সাহেবের কাছে মার ছুটে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে আমার কথা যাচাই করে নেয়া। মার স্বভাব হচ্ছে–যে যাই বলুক না যাচাই করে নেবেন।
মা কাউকেই বিশ্বাস করেন না। কোন ফেরেশতা এসে যদি মাকে বলে–আপা শুনুন, আপনার মেয়েকে দেখলাম একা একা রিকশায় করে নিউ মার্কেটে যাচ্ছে। মা সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, ও কী রঙের সালোয়ার পরেছে বলুনতো?
আমার খুব অস্বস্থি লাগছে। কী বিশ্রী ব্যাপার হল। ডিরেক্টর সাহেব যখন বিরক্ত গলায় বলবেন, কই আমিতো আপনার কন্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলি নি। তখন কী হবে! তিনি হয়ত হাত উঁচিয়ে আমাকে ডাকবেন।
এত দূর থেকেও হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমার মা হেসে হেসে কী যেন বলছেন। মঈন সাহেব মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন তার মুখে হাসি নেই, তবে বিরক্তিও নেই। শুধু পাপিয়া ম্যাডাম বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন। বেশির ভাগ সময়ই তিনি বিরক্ত হয়ে থাকেন।
পাপিয়া ম্যাডাম বসে আছেন মঈন সাহেবের পাশে। তাঁর হাতে বড় একটা গ্লাসে হলুদ রঙের কী একটা জিনিস। তিনি চুক চুক করে খাচ্ছেন। মার অকারণ হাসিতে সম্ভবত তার মাথা ধরে যাচ্ছে। পাপিয়া ম্যাডামের সব সময় মাথা ধরে থাকে।
পাপিয়া ম্যাডাম আমাদের এই ছবির নায়িকা। আমি এত সুন্দর মেয়ে আমার জীবনে দেখি নি। মোমের পুতুল বললেও কম বলা হবে। তার ঠোঁট সুন্দর, চোখ সুন্দর, নাক সুন্দর, দাঁত সুন্দর। লম্বা সিল্কি চুল যা দেখলেই হাত নিয়ে ছুঁতে ইচ্ছে করে। এবং কেঁচি দিয়ে এক গোছা চুল কেটে বাড়ির দেয়ালে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। তাকে দেখলে প্রথম যে কথাটা মনে হয় তা হচ্ছে——মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে? হেলেন অব ট্রয় কিংবা ক্লিওপেট্রা এরা কি তার চেয়েও সুন্দর ছিল? মনে হয় না।
মা তর তর করে ছুটে আসছেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি। মনে হচ্ছে জটিল কোন মিশন সম্পন্ন করে ফিরছেন। মিশনের ফলাফল তার পক্ষে।
বকু, তোকে বেলের সরবত দিয়েছে?
আমি কিছু বললাম না। মা হড়বড় করে বললেন, ইউনিটের সবাইকে বেলের সরবত দিয়েছে তোকে দিচ্ছে না কেন? তুইতো ফেলনা না, তুই এই ছবির দুই নম্বর নায়িকা।
মা চুপ করতো!
চুপ করব কেন? মঈন ভাইয়ের কানে আমি এক সময় কথাটা তুলব। সবাইকে সব কিছু সেধে সেধে দেয়া হয়–তোর বেলায় চেয়ে চেয়ে নিতে হয়। কেন তুই কি বন্যার জলে ভেসে এসেছিস? নাকি বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে আকাশ থেকে পড়েছিস?
উফ মা— চুপ কর।
সব সময় চুপ করে থাকলে হয় না। জায়গা মত কথা বলতে হয়। নিজের জিনিস আদায় করে নিতে হয়। বুদ্ধি খেলাতে হয়। তুই বুদ্ধি খেলাতে পারিস না। সবার মেয়ে হয় বুদ্ধিমতী, আর তুই হয়েছিস বোকামতী।
মা চলে যাচ্ছেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, তবে নিশ্চিত হতে পারলাম। মা সহজে কিছু ছেড়ে দেন না। বেলের সরবত প্রসঙ্গ এই খানেই চাপা পড়বে বলে মনে হয় না। যথাসময়ে ডিরেক্টর সাহেবের কানে উঠবে।
মার কথাগুলি মনে পড়ে এখন একটু হাসি পাচ্ছে— কেমন চোখ মুখ শক্ত করে বলছিলো–সব সময় চুপ করে থাকলে হয় না। জায়গা মত কথা বলতে হয়। নিজের জিনিস আদায় করে নিতে হয়। ভাবটা এ রকম যেন মা সব সময় নিজের জিনিস নিজে আদায় করে নিয়েছেন। আসলে তিনি কিছুই নিতে পারেন নি। বরং তার নিজের যা সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিতে হয়েছে।
আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন আমার বাবা আমাদেরকে ছেড়ে চলে যান। আমার বুদ্ধিমতী মা একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েন। তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি–এরকম একটা ব্যাপার ঘটতে পারে। তিনি নানান ধরনের পাগলামী করার চেষ্টা করেন। গোলাপ গাছে স্প্রে করে দেয়ার যে বিষ ঘরে ছিল সেটা খাওয়ার চেষ্টা করেন, খানিকটা মুখে নিয়ে গু করে ফেলে দেন। এতেই তার মুখে ঘা-টা হয়ে একাকার। একবার পঞ্চাশটার মত ঘুমের অষুধ খান। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বমি হয়ে যাওয়ায় সেই অষুধে টানা আঠারো ঘন্টা ঘুম ছাড়া তার আর কিছুই হয় না। তারপর উঠে-পড়ে লাগেন, গুণ্ডা লাগিয়ে বাবাকে মারার ব্যবস্থা করবেন। সেই নিয়ে দিনরাত আমার সঙ্গে পরামর্শ— বুঝলি বকু এমন মারের ব্যবস্থা করব যে প্রাণে মরবে না তবে হাত পা ভেঙ্গে লুলা হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবে। পিশাব পায়খানা বিছানায় করবে। আমাকে চিনে না? আমি তার বাপদাদা চৌদ্দগুষ্ঠির নাম ভুলিয়ে দেব। পাতলা পায়খানা করিয়ে ছাড়ব। কলসি ভর্তি ওরস্যালাইন খেয়েও কূল কিনারা পাবে না।