এবার আর্তনাদ করে উঠল সাদইদ–কী বলছ হেরা! তুমি কী বলতে চাও, রিবিকাকে আমায় ফিরিয়ে দিতে হবে! ঘোড়া কখনও ফিরবে না। ফিরতে পারে না!
সাদইদের কথা হেরা বুঝতে পারে না। ঘোড়ার সঙ্গে রিবিকার কী সম্বন্ধ? তারপর বুদ্ধিমান হেরার হৃদয় সমস্তই অনুভব করতে পারে। তার কাছে আলোকিত হয়ে ওঠে সাদইদের হৃদয়। মাথা নিচু করে হেরা।
–তোমার কথা ফিরিয়ে নাও হেরা!–সাদইদ পাগলের মত বলে।
হেরা কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে। সাদইদ সাদা অশ্বটাকে খাড়া করে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে, সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হেরার মনে হয় তার বলার মত কোন কথাই যেন নেই।
হঠাৎ বলে–কারিগররা চলে যেতে চাইছে সাদইদ!
–না। অসম্ভব। যেতে পারে না। কিছুতেই পারে না। আমি বহু কষ্টে ওদের জোগাড় করেছি!
বলেই সাদইদ অশ্ব ছুটিয়ে দেয়। দ্রুত বেগে কারিগর পাড়ায় এসে পথ অবরোধ করে দাঁড়ায়। একা।
চিৎকার করে বলে–তোমরা যেও না। তোমাদের আমি কাজ দেব।
কারিগরদের মধ্যে একজন মাতব্বর বলে ওঠে–ইহুদ চান না আমরা থাকি। আমরা কী করব! কাজও তেমন পেলাম না। একটা নগর গড়ে তোলা সহজ নয় সারগন। আপনি চান ঠিকই, হয়ত একদিন কাজও আমরা পাব। কিন্তু এখানকার পুরনো বাসিন্দারা আমাদের ঠিক সইতে পারে না। আমরা সবাই বউ সঙ্গে আনিনি। কিছু কিছু এনেছি। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগছে, চাষার ছেলেদের অত্যাচারে বউরা মাঠে গিয়ে প্রাতঃকাজ করতে পারছে না, ছোকরারা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। তখন ভোর পুইয়ে সাফ হয়নি, একজন চাষার বেটা কচি বউটাকে হামলা করে মাঠে পেড়ে ফেললে! দেখুন! আমরা নিরীহ লোক। আমরা ফরাতের তীরে ভাল সূক্ষ্ম কাপড় বানিয়েছি কত। এরা মোটা কাপড় বোঝে, পাতলা কাপড়ে ইহুদের আপত্তি আছে। ওদিকে কুমোর পাড়ায় গিয়ে দেখে আসুন! টালি বানাতে দিচ্ছে না। ভাঁটার গর্ত বুজিয়ে দিয়েছে। পাথরের উপর গর্ত করে একটা পাত্র বানানো হয় এখানে। কী মোটা কাজ! নিনিভের কুমোররা সূক্ষ্ম কাজ জানে। একটা ঘটির কী নকশা ভেবে দেখুন!
হেরা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছিল। ওকে দেখে কারিগররা বলল–উনি আমাদের কতরকম নকশার কথা বলেন! কিন্তু এখানে সেসব সম্ভব নয়। আপনি দেশের উন্নতি করুন, তারপর আমরা আসব!
সাদইদ বলল–কিন্তু যাবে কোথায় তোমরা!
–অন্য কোন রাষ্ট্রে চলে যাব। আপনার সাধ আহ্লাদ আছে, কিন্তু ব্যবস্থা নেই। টালির উপর নকশা করবেন হেরা, কিন্তু আপনার দেওয়াল কোথায়! সূক্ষ্ম কাপড় পরবে, তেমন মানুষ নেই। আমাদের এরা যাযাবর ভাবছে, কিন্তু এদের কোন শিক্ষাদীক্ষা আছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া ভাবছে, আমরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছি! কতরকম অপমান সইতে হয়। মুখের ভাষা শুনে সেই ভাষার উপর টিটকিরি করার জন্য ছন্দবাঁধা বোল তৈরি করছে। আসলে আমরা কি যাযাবর, হেরা, আপনিই বলুন!
মাতব্বরের কথা শুনতে শুনতে হেরা বলল–আপনারা সাদইদের আন্তরিকতার মূল্য দেবেন আশা করি! দেখুন! আমার চেয়ে কর্মহীন আপনারা কেউ নন। কবে আমার কাজ শুরু করতে পারব কিছুই জানি না। এখানে কাপড়ের সূক্ষ্মতাই যখন বোঝে না, তখন আমার শিল্প কে বুঝবে! তবু রয়েছি, যদি কখনও হয়ে উঠে কিছু!
একজন বলল–এই তো আপনার মাটির ঘোড়াটা গুঁড়িয়ে ভেঙে পড়ল । এখানে জিব্রিলের কোপ পড়েছে হেরা! অবশ্য আপনার ঘোড়াটা খুব বেড়ে হয়েছিল। মাটির হলেই বা হবে না কেন, পাথর হলে আরো দাম্ভিক দেখাত । দর্প জিনিসটা খারাপ। ইয়াহুদের কথা ফেলা যায় না। তাছাড়া এখানে সুতোও পাওয়া মুশকিল! বরং যা আছে তাই থাক। গম দিয়ে বণিকদের কাছে কাপড় কিনে নেবে এখানকার লোকেরা! মোটা কাপড়।
হেরা বলল–সূক্ষ্ম কাপড়ও তো দর্প, অহংকারের জিনিস ভাই! তোমার কথার ভিতর খাদ আছে!
মাতব্বর বলল–দেখুন হেরা, আহত হবেন না। সামান্য মানুষ আমরা । যেখানে ব্যবস্থা ভাল দেখব চলে যাব। নিনিভে আমার দেশ ছিল। ইয়াহহ জিব্রিলকে পাঠিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইয়াহুদ যখন চাইছেন না, আমরা থাকতে পারব না। চলো হে, চলো! বেলা চড়ে যাবে।
চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে কারিগররা, সাদইদ কোন কথাই বলতে পারছে না। ভাবল, হেরা ভাবল নিজের সূক্ষ্মতাটা মানুষ বোঝে, অন্যেরটা ধরতে পারে না। অন্যের জিনিসে সে অহংকার খুঁজে পায়। যা সূক্ষ্মতর, তারই ভাগ্য খারাপ। তার যশ নেই, উপেক্ষা রয়েছে। তাকে মারবার জন্য রয়েছে জিব্রিল। অথচ এখন মুখ বুজে থাকাই ভাল। জিব্রিলই কি ঈগল পাখির মত আকাশে ওড়ে? একটা পাগলা পাথর যখন পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে, তা কি তখন জিব্রিলই ধাক্কা দেয়? কারিগররা যে চলে যাচ্ছে, কে টেনে নিয়ে চলেছে এদের? হেরা ভাবল, ইহুদের ধর্মটা মন্দ নয়! তাকে ঘোরতর অবিশ্বাস করলে কালো ঘোড়ার বদলে পাওয়া যায় একটি বেঁটে ধূসর গাধা-নিনিভের বদলে কনান। হেরা ভাবল, সেও কি তবে চলে যাবে কোথাও–এখানে অর্থহীন আয়ু ক্ষয় করার কি সত্যিই কোন মানে আছে? বাচ্চা এবং নিনিভাকে সে পেয়েছে, এবার রওনা দেওয়া যায়।
এমন সময়, সাদইদের কম্পিত একটা হাত হেরার কাঁধের উপর এসে আশ্রয় পায়। সাদইদের হাতটি যেন হাত নয়। হৃদয়। হৃদয় হেরাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। সাদইদের চোখ চিকচিক করছে। সেদিকে চোখ তুলে হেরা চোখ নামিয়ে নিল। এই সাদইদ তাকে মড়কের মুখ থেকে টেনে এনেছে। নিনিভাকে, শিশুকে উপহার দিয়েছে কুটির বেঁধে দিয়েছে। অথচ লোকটির কেউ নেই। রিবিকা এক মরীচিকা! লোকটি লোটার চেয়েও হতভাগ্য–সবই সামনে রয়েছে, সবই সে স্পর্শ করতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারে না। তথাপি আঁকড়ে ধরতে চায় । হেরা তার কাঁধের উপরে এসে পড়া সাদইদের হাতের উপর নিজের একটা হাত তুলে স্পর্শ করল। সাদইদ কেঁপে উঠল।