চাষীদের সঙ্গে তাঁবুঅলাদের সীমানা এভাবে নির্দেশ করেছে মানুষ। চাষীর ক্ষেতে যাতে তাবুর পশুরা হানা না দিতে পারে। পশুদের থানা বসানো হয়েছে। চাষীদের গ্রামের ভিতর। সমস্যা গুরুতর হলে ইহুদের ডাক পড়ে। তিনি বিচার করে দেন। চাষীরা তার বিচার মান্য করে। কারণ তিনি নবী। সবই সত্য। কিন্তু ইহুদের অনুগামী মরুভূমির মানুষ আজও আলাদা হয়ে রইল–একখানা তাবু পর্ণকুটিরে রূপান্তরিত হওয়া কী শক্ত!
তারবেড়া যেন সেই মরুভূমির সৈন্যশিবির। সাদইদ খুব আশ্চর্য হয়–সৈনিকরা এই ভোরে বর্শা ছোঁড়া অভ্যাস আছে; তাহলে কি যুদ্ধ শেষ হয়নি! নাকি চাষীদের ভয়ে অথবা চাষীদের ভয় দেখানোর জন্য এই বর্শাযুদ্ধের খেলা! আচ্ছা, একজন সৈনিক কি কখনও যুদ্ধ ত্যাগ করে না? একজন ভাড়াটে সৈনিক কি কখনও চাষী হয়ে ওঠে না? যে লোকটি একদা চাষীই ছিল সে কেন তার পূর্বের বৃক্ষের স্বভাব ফিরে পায় না? যে ছিল, সে থাকেনি, এ তার শাপলাগা জীবন, কিন্তু মরুভূমি তো আর নেই, সে এসেছে মাটিতে, তু কেন সে শস্ত্র অভ্যাস করছে? হঠাৎ সাদইদের রাত্রির দৃশ্য মনে পড়ল। কালো ঘোড়া বিদ্ধ। হয়ে চিৎকার করছে। বর্শার খেলা কি তবে কোন একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি।
একজন চাষী কাঁধে গামছা ফেলে খাটো লুঙ্গি পরে সামনে পথ ভাঙছে দেখে সাদইদ চোখের ইশারায় তাকে ডাকল। চাষীটি সামনে এসে মাথাটি খুঁকিয়ে সেলাম জানাল সাদইদকে। তারপর বলল–কী দেখছেন রাজা! ওই ভয়েই তো মরছি আমরা। ভেবে দেখুন, কে বেদে, কে নয় বলা যাবে না। কে আগে, কে পরে এই কানে থিতু হয়েছে, তারও সন তারিখ নাই। কতজন পরে এসে ঘর পেয়েছে, জমি পেয়েছে, বুদ্ধি আর গায়ের জোর! তবু মুশকিল আসান হল না। আকাশের মালিকরা, ওই দেবদেবীরা মানুষকে আলাদা করেছে, মুখের কথা। ভেন্ন ভেন্ন–এ প্রত্যয় সবার। কিন্তু ইয়াহুদ বেচারি হামলে মরছে, কী হবে কে জানে! কখনও বলছে, লড়াই ভুলে যেও না, কখনও বলছে অস্তর ধারণ করো না। কিন্তু একজন সেপাই কি অস্তর ছাড়ে!
একটু চুপ করে থেকে তাগড়া, কপাল-কাটা চাষীটা বলল–আপনাকে টিকে থাকতে হলে অস্তর শান দিয়ে রাখতে হবে। মোদ্দা হল, যুদ্ধের মুড়ো ল্যাজা নাই। শ্যাষ নাই রাজা। সেইটে আপনার শুঁটকি বনাম কাকড়া হতে পারে। উট বনাম অশ্ব কি ষণ্ড হতে পারে। পূর্বপুরুষ নোহু বলে গিয়েছেন সক্কল হল জীব। তিনি তোমার ভেলায় শুঁটকি মাছও রাখলেন, কাকড়াও রাখলেন। তাই কিনা!
–হ্যাঁ! তাই তো রেখেছিলেন! সাদইদ মাথা দোলাল।
হঠাৎ কোথা থেকে একজন ছোকরা চাষী ছুটে এসে বলল–আরে বাবা, নোহু অত বোকা ছিলেন না! খেয়েদেয়ে কাজ নেই মরা মাছ তুলতে যাবেন ভেলায়। কিন্তু কাকড়ার জান সহজে যাবার নয়। সেই কথা রাজাকে বলে
প্রথমে যে এসেছে, বয়স্ক চাষী, সে ত্বরিতে জবাব করল–সেই কথাই তো কইছি ভাই রাজাকে। আমরা মশাই, একটু-আধটু কাঁকড়া খাই। দুধও খাই কাঁকড়াও খাই। নোহু যে পদার্থ ভেলায়’ তোলেন নাই, সেই মরা জিনিস ছুঁই না! ওসব হল পূর্বদেশীদের অভিরুচি। আপনিই বলেন, কার গন্ধ খারাপ–যেটা মরা সেইটে, নাকি যেটা তাজা রইল সেইটে! ওরা কি বলে শুনবেন, কাঁকড়া হল, থলচরা, মানে মাটিচরা আর জলচরা–উভয়। সেইটে নাকি দোষ! আর গায়ে খালি খোসা। ওই কাঁকড়া নাকি মরুভূমি থেকে এসেছে! কথার কী মাহাত্ম্য দেখুন! আরে বাবা, মরুভূমি থেকে এসেছে বিছে। যত বিষ, সব এসেছে! পূর্বদেশীদের কাছে আমি সৃষ্টি-পুরাণ শিখব মনে করেছে! যা মুখে আসবে বলবে, ফেরাউনের রাজত্ব পেয়েছে কিনা! তা আপনার অভিরুচি একবার শুনতে পাই রাজা!
সাদইদের সহসা মনে হল, বয়স্ক চাষীটি তাকেও যেন বিদ্রূপ করছে। তবু সে হেসে ফেলে বলল–আমি তো রাজা! সমস্ত দেহে বিষ। কিন্তু জন্মেছিলাম এই মাটিতে। কার জন্য ভাড়া খেটে মরেছি জানি না। কে আমার ঈশ্বর তাও জানা নেই! কী খেয়ে বেঁচে থেকেছি তারও কোন বিচার করিনি কখনও। আমি শুধু একটা বীজ কীভাবে পূতলে সোজা হয়ে মাটি খুঁড়ে উঠবে সেই কথা ভাবি। আমি তোমাদের জন্য উন্নত চাষ কীভাবে সম্ভব, সেই নিয়ম চালু করেছি।
অবরুদ্ধ এক আবেগকে ঠোঁটের আড়ালে চেপে ধরে সাদইদ বলল–সব মানুষ মাটি চায়। মরুভূমি কেউ চায় না। অথচ যুদ্ধটা থাকে মরুভূমির বুকে। এখানে এসে আমি দেখলাম, মাটি কখনও রক্ত চায় না। সে চায় নিজেরই প্রলেপ। পলিজল। মাটির নিয়ম মাটিরই নিজস্ব। সে কারো মুখ চেয়ে বসে নেই। মানুষের রক্তের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। সে চেয়ে থাকে নদী আর বিশাল আকাশের দিকে। নোহ তাই আকাশ দেখেছিলেন,আর নদী। সেখানে বন্যার সংকেত ছিল। আমরা যাই খাই না কেন, দুনিয়ার শিশুরা মধু খেতে ভালবাসে। আমি চাই প্রচুর মধু আর দুধ। বাগান গড়ে না উঠলে স্বর্গের পথ। তৈরি হবে না–বিষ না মধু, এবার তোমরাই বল!
দু’জন চাষীই ঘাড় নিচু করে কথা শুনছিল। সাদইদের কথার কিছু তাদের বোধগামী ছিল, কিছু-বা ছিল না।
হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে ছোকরা চাষীটা বলল–আপনাকে আমরা বলে রাখছি–ফসল এবার সাধারণ হয় নাই। চাষীর মন ভাল আছে। নববর্ষে দেবীর মণ্ডপে যেন সেপাইরা বিবাদ না বাধায়। আমরা নিজেদের ভিতর যত নষ্টামিই করি, সে আমাদের নিজস্ব রেওয়াজ। ওইদিনে একটু-আধটু মাতলামি হয়, ইয়ে হয়–যার যাকে ভাল লাগে মেয়েপুরুষ–বুঝলেন রাজা–বাপ-ঠাকুদ্দার জিনিস–নইলে মেঘ কী করে আসবে। মেয়েদের আগ্রহই বেশি। তাই বলে একটা সেপাই আমার পরিবারকে ধরে টানবে–এই অনাছিষ্টি সইব না! আপনি রাজা বলে মানি, ইয়াহুদ নবী বলে মানি। কিন্তু আমাদের দরবার উভয়ের কাছে।