সকলে উচ্চহাস্যে বিদ্রূপ করে উঠল। কিসের মাতমে এরা সব বধির হয়েছে, সাদইদ ভেবে পেল না। আবার বলে উঠল–আমরা এখনও চলে যেতে পারি লোটা! রিবিকা তুমি বলে দাও–সব কথা বলে দাও নোটাকে।
রিবিকা শিহরিত হয়ে উঠল। তার প্রাণ বলল, সে বলে দেয়। সে চোখ তুলে কতজনের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাইল, কোথাও সে কণামাত্র সমর্থন পেল না। সবাই যেন এক পাষাণের মত স্থির, চোখে এক মদির স্বপ্ন জমাট বেঁধে আছে, কিন্তু কোন তরঙ্গ নেই। রিবিকা হতাশায় ভেঙে পড়ল আপন হৃদয়ে। তারপর সে মহাত্মার দিকে চোখ তুলল।
ইহুদ বললেন–আমার ধর্মে কোন প্রতিমাপূজা নেই। আমার ধর্ম দেবতা সামাশ বা আমনের চেয়ে শক্তিশালী। ইয়াহো নিরাকার। তাঁর কোন শরিক নেই। তিনি অদ্বিতীয় ঈশ্বর। বলল, তিনি যা তিনি তাই। তুমি এই কথাগুলি লোটাকে বলিয়ে নাও। এই মন্ত্রই বিবাহের মন্ত্র। এখানকার সমস্ত পুরুষ তোমার মত নারীর স্বপ্ন দেখে। আমি সকলকে সেই স্বপ্নের দিকে নিয়ে চলেছি। তোমরা সকল বিগ্রহ বর্জন কর। ইয়াহো সূর্যকে অবধি নিয়ন্ত্রণ করেন। বাতাস তাঁরই নির্দেশে চলে, মেঘ বৃষ্টি, সমুদ্র নদী তাঁরই ইশারায় আন্দোলিত হয়। বৃক্ষের একটি পাতাও তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কাঁপে না।
ঠিক এই উচ্চারিত মন্ত্র রিবিকা বলে উঠবে, তখনই হিতেনের রথকে দুটি ঘোড়ায় টেনে আনল মরুপথ বিদীর্ণ করে তীব্র বেগে। শিঙা নিনাদিত হল।
মহাত্মা ইহুদ রাজার উপস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে লোটা আর রিবিকার বিবাহ নিষ্পন্ন করলেন। বিবাহের দৃশ্য দেখতে দেখতে হিতেনের দুই চোখ মহাক্রোধে চকচক করে উঠল। রাজা এসেছে লোটাকে বধ করতে আর সুন্দরী রিবিকাকে রথে তুলে নিতে। এ দৃশ্য তার কাছে অভাবিত, অপমানজনক। সে হুংকার দিয়ে উঠল। বলল–সৈনাধিপতি সাদইদ, এ কী দেখছি আমি! সুন্দরীকে টেনে আনো আমার কাছে! লোটাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে চলো!
একজন সৈনিক বলে উঠল–সাদইদের আধিপত্য আমরা স্বীকার করি না। রাজা হিতেন। তুমি ফিরে যাও।
–এতবড় স্পর্ধার কথা কী করে বলছে লোকটা!
–যে ফেরাউন আমাদের সর্বস্ব ধ্বংস করেছে–আমার জমিজমা, বউ, সন্তান নষ্ট করে দিয়েছে, তারই হয়ে ভাড়া খাটছি আমরা–এই অপমান কত সইব বলতে পারো! তোমার তদারকির পরোয়া করি না রাজা। তুমি ফিরে যাও। ফেরাউন আমার হাতের আঙুল কেটে দিয়েছে, এই দ্যাখো!
দু’ হাত মাথায় তুলে দেখালো সেই সৈনিক।
–অসম্ভব! ওই সুন্দরীকে আমার চাই! বলল রাজা হিতেন।
ইহুদ বললেন–মা রিবিকা, তুমি এবার লোটাকে বলে দাও, রাজা তাকে বধ করতে এসেছে!
রিবিকার ঠোঁট দুটি থরথর করে কেঁপে উঠল। সে কিছুতেই এতবড় মর্মান্তিক কথা উচ্চারণ করতে পারছিল না। তার কেবলই মনে পড়ছিল তার মায়ের ভাষা ছিল লোটারই মত বিচ্ছিন্ন,সকলে তাকে ঘৃণা করত। মা ছিল বাবার উপপত্নী! লোটার মুখটা তেমনই সরল।
ইহুদ এবার রিবিকাকে ধমক দিয়ে উঠলেন। রিবিকার চোখ দুটি এমন অসহায় মুহূর্তে সাদইদকে খুঁজছিল। সে নিজেও অবাক হল, তার চোখ কেন সাদইদকেই খুঁজছে!
হিতেন গর্জন করে উঠল–সাদইদ লোটাকে বাঁধো–আমার হুকুম!
সাদইদ তার সাদা অশ্ব রাজার রথের কাছে হাঁকিয়ে নিয়ে এল। তারপর বলল–আপনার সঙ্গে রয়েছে সারথী আর মাত্র একজন ঢাল ধরা সৈনিক-তাই সম্বল করে এত হাঁকাহাঁকি ঠিক নয় মহারাজা।
রাজা হিতেন উচ্চ হাস্য করে উঠল। বলল–তুমি বড় মূর্খ সাদ। তোমায় সন্ধিফলক মাগনাই দিয়েছি দেখছি।
এই সময় দূরে থেকে প্রখর তূর্যনাদ ভেসে এল। দেখতে না দেখতে সমস্ত তল্লাট রাজা হিতেনের অশ্বারোহী সেনায় ভরে গেল। লোটার কোমরে দড়ি বাঁধা হল শক্ত করে–দুহাত বাঁধা হল। সন্ধ্যার আগের সূর্যালোকে নীল আকাশ রক্তে প্লাবিত। সেই দিকে দু চোখ মেলে লোটা হাঁটতে থাকল বধ্যভূমির দিকে।
রিবিকা লোটার ভাষায় আর্তনাদ করে উঠল–যেও না লোটা, রাজার লোক তোমায় হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছে! মহাত্মা ইহুদ, এ আপনি কী করলেন।
প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ল রিবিকা। দুহাত মুখ ঢেকে মাটির উপর বসে পড়ল। যে ক্রীতদাস সৈন্য দু হাতের আঙুল কেটে দিয়েছে মিশরের দাসমালিক বলেদু হাত তুলে দেখাচ্ছিল সেই সৈনিকটি রিবিকার কাছে এগিয়ে এসে বলল–কেঁদো না বউ! তুমি কাঁদলে মানুষের সংসার কাঁদে!
লোটা আকাশে চোখ মেলে এগিয়ে চলেছে, তার পিছু পিছু সমস্ত মানুষ ধীরে ধীরে দীর্ঘ সারির মিছিলে চলতে শুরু করেছে। সাদইদ সেই প্রবাহের দিকে বিষাদপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়েই রয়েছে। তার করার কিছুই নেই।
লোটা প্রায়ই বলত, যা রিবিকা অনুবাদ করেছিল সেদিন আমি একদিন বৃষ্টি ঝরা ভোরে ঝাঁপসা দিগন্তে উটের পিঠে চড়ে চলে যাব, আর ফিরব না।
কিন্তু এখন তো সন্ধ্যাকাল। সবাই চলে গেছে বধ্যভূমির দিকে। ভয়াবহ আর্তনাদ করে উঠলেন মহাত্মা ইহুদ। ইয়াহো! ইয়াহো। …
তারপর হঠাৎ তিনি স্বয়ং বধ্যভূমির দিকে পাগলের মত ছুটতে শুরু করলেন। রাজার রথ ধীরে ধীরে তাঁর পিছু পিছু এগিয়ে চলল। বাবার পিছনে ছুটে গেছে রিবিকা–তার ছুটে যাওয়ার দিশে ছিল না।
এমন সময় বধ্যভূমির কাছে মিছিল থামলে এই মরুমর্তে এক আশ্চর্য দৃশ্যের ঘটনা দেখা যায়। নোটাকে আঁকড়ে ধরেছে রিবিকা। মহাত্মা ইহুদ বলছেন–এই কান্নার শেষ কি নেই? ঈশ্বর!
লোটার বুকে লুটিয়ে পড়েছে রিবিকা।