–আমাকে ক্ষমা করুন। বলতে বলতে রিবিকার মাথা ঘুরে উঠল। সে ঘোড়ার গা খামচে ধরল।
সাদই বলে যেতে লাগল–তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমাকে যে মন্দিরটা দেওয়া হবে, তা খুবই পরিচ্ছন্ন আর আধুনিক। সূর্যমন্দিরই পাবে তুমি । সূর্য যতদূর আলো ছড়ায় একজন সৈনিক আকাঙ্ক্ষা করে সে ততদূরই পৌঁছবে। কিন্তু সারগনও তা পারেননি। কিন্তু সূর্যের বর পেয়েছে দেবদাসী–সবখানে তার দেশ। মহাপিতা নোহের কাহিনী সবদেশে আছে, দেবদাসীর কাহিনীও মানুষের যুদ্ধের সঙ্গে জড়ানো–সর্বত্র আছে। মন্দিরে তোমাকে পাহারা দেবে সমর্থ একজন গামছাবালা। তোমার কাছে আসবে রাষ্ট্রনায়ক, মন্ত্রী। সত্যি বলতে কি তোমার জন্য মোতায়েন হবে গামছাবালা-এরা দালাল চরিত্র নয়। প্রহরী বলতে পারো। মিলনের আগে এবং পরে সেই গামছাবালা তোমার ও তেনার নানারকম সেবা করবে। লাঠিধারী যেমন পদবী, গামছাবালাও তাই।
শুনতে শুনতে রিবিকা অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে খসে পড়ল। ক্ষুধায় এমনিতেই এত কাহিল ছিল যে, গা কাঁপছিল; তার কম্পিত হৃদয়ও আর চিন্তা করতে পারছিল না। পড়ে যাওয়ার শব্দে পিছনে ফিরে তাকাল সাদইদ। দেখল মেয়েটি মূৰ্ছা গিয়েছে। তার বুকের উপর থেকে কাপড় সম্পূর্ণ সরে গিয়েছে। একটি প্রজাপতিও আর জীবিত নেই। ভোরের এই অরণ্য আড়াল দেওয়া টুকরো টুকরো আকাশে প্রজাপতির রেণু মাখিয়েছে কে!
সে আপন মনে লজ্জা পেল, গামছাবালা যে পদবী সে যে দালাল নয়, একন নির্যাতিতার সামনে এসব এমন করে বিবৃত করা ঠিক হয়নি। মেয়েটিকে নিয়ে এখন সত্যিই সে কী করবে! মেয়েটি তো জানে না এই পুরুষটি আসলে কে–কী তার ভাগ্যের পরিচয়। গামছাবালা কথাটি কি আর সাধে সাধে মুখে আসে!
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল সাদইদ। মহাপরিচালক কথাটাও কি কম পরিহাস্য! মর্যাদা! নিরীহ অসহায় নারীর কাছে মর্যাদার কথা! সামান্য একজন ভাড়াটে সৈনিক! যারা মিশর থেকে, আসিরীয় ভূখণ্ড থেকে, বাবিলন থেকে গুপ্তপথে, চোরাপথে পালিয়ে আসা সৈনিক, তারাই তার সহচর। একত্র দল গড়েছে–সেই দল ভাড়া খাটে, তারই পরিচালক সে। যুদ্ধ শেষ হলে কিংবা আসিরীয় নগরী নিনিভে ধ্বংস হলে তাদের আর কোনই দাম থাকবে না। যুদ্ধ থাক, কিন্তু নগরী যেন ধ্বংস না হয়। একটা বড় নগরী ধ্বংস হওয়ার পর কিছুকাল যুদ্ধ থেমে থাকে। বিজয়ী জাতি ভাড়াটে সেনাদের নিজের রাষ্ট্রে বন্দী করে আবার । স্বপ্নের পাহাড়, ক্ষুদ্র অরণ্য, মরূদ্যান, মন্দির, দেবদাসী–সব কেড়ে নেয়। যুদ্ধ থামলে আবার তাকে পার্বত্য নগরীর মধ্যে হিত্তীয় রাষ্ট্রের সৈন্যশিবিরে,নতুবা কোথাও ঠাঁই নিতে হবে।
অথচ কনান তার দেশ। মহামতি হিত্তীয় রাজা হিতেন তাকে এই যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার সময় খানিকটা স্বাধীনতা দিয়েছেন মাত্র। সে নিজের উদ্যোগে সৈন্যদল গড়েছে। তথাপি হিতেনের যুদ্ধবিদ্যা সাদইদের অধিগত হয়েছে হিতেনের বদান্যতায়–ফলে হিতেনের কাছে তার আনুগত্য প্রবল।
হিতেন সাদইদকে একটি ছোট পাহাড়, কিছু মন্দির এবং শিবির স্থাপনের জন্য এই সামান্য অরণ্য দিয়েছেন। এখানে ছোট একটি দ্রাক্ষাকুঞ্জ আর দুটি কূপ এবং ক্ষুদ্রাকৃতি মরূদ্যানের বিস্তার আছে। দ্রাক্ষাকুঞ্জের কাজ করে আহত সৈনিকরা–বিশ্রামের জন্য তাঁবু খাটায়। পাহাড় এখান থেকে পঞ্চাশযাট মাইল দূরে অবস্থিত। সেখানেই রয়েছে নতুন মন্দিরগুলি। হিটাইটরা (হিত্তীয়) অশ্ব চালনাতেই কেবল পারঙ্গম, তাই নয়, এরা মাটির ইট, বালির তাপে শক্ত করে নিয়ে বাড়ি তৈরি করতেও পারে। সেই গৃহগুলি পাথর এবং ইটের প্রস্তুত। ঠিক সেইভাবেই তারা মন্দির গড়েছে।
এইসব মন্দিরগৃহ উপাসনার জন্য তৈরি নয়। সৈনিকরা এখানে দেবদাসীদের হাতে মদ্যপান এবং রাত্রিবাস করার জন্য আসে; আক্রান্ত জাতির সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে দেবদাসী করা হয়। তারা অধিকাংশই পুরুষহীন। তাদের পুরুষরা হয় যুদ্ধে নিহত, নতুবা জেল খাটছে অথবা পঙ্গু। যুদ্ধে ক্রমাগত পুরুষের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে দেবদাসীদের সংখ্যা দিনে দিনে অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে।
একটি নগরীর শ্রীবৃদ্ধি মানে দেবদাসীর সংখ্যা-বৃদ্ধি। দেবতা সামাশের জয়জয়কার। নারীকে পুরুষহীন না করতে পারলে সৈনিকদের জন্য দেবদাসী সরবরাহ করা যাবে না। দেবদাসী না থাকলে সৈনিকরা যুদ্ধ করবে না। দেবদাসীর সংখ্যা বাড়লে মন্দিরের সংখ্যা বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে গামছবালার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। পরাধীন রাষ্ট্রের পুরুষদের জন্য গামছা কাঁধে করা চাকরি নির্দিষ্ট। হয় সে দ্রাক্ষার মদ বানাবে, নয় গামছা কাঁধে ফেলে টুলের উপর বসে থাকবে দেবদাসীর মন্দিরের দরজার কাছে। আবোবদনে এইধারা বসে থাকাই হল সভ্যতার চিহ্ন। যে দেবদাসীর সৌন্দর্য যত বেশি তার গামছাবালার চাকচিক্যও তত বেশি।
সংজ্ঞাহীন রিবিকার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে জীবনে এই প্রথম সাদইদের মনে হল, দেবদাসীদের পাড়ায় এই মেয়েটির খুব কদর হবে। কিন্তু এই মেয়েটিকে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে তুলতে সাদইদ বুকের মধ্যে কেমন একধারা কষ্ট অনুভব করছিল।
ঠিক সে জানে না, এই কষ্টটাই বা কিসের! এমন তো কখনও হয়নি। যার পুরুষ নেই, তার তো ঈশ্বর আছেন! গামছাবালা এবং পুরুত আছে। সর্বোপরি সৈনিকদের আদর-সম্ভাষণ তো রয়েছেই। সাদইদ কূপ থেকে মাথার টুপিতে করে জল বহে এনে রিবিকার মুখে প্রক্ষেপ করতে করতে ভাবল–আমি না হয় দেবদাসীর ঈশ্বরকে অথবা যে কোন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি না–তা বলে আমনদেব সূর্য তো মিথ্যে হয় না। সে প্রতিদিন আকাশে আসে। ঈশ্বর যবহ পাহাড়ে বসে চোখ রাঙায়। দেবতার আশীর্বাদে একজন প্রথম শ্রেণীর দেবদাসী কত সমাদৃত হয়। নগর রাষ্ট্র ধ্বংস হয়, তেমন রূপসী দেবদাসী ধ্বংস হয় না। একটি নগর শেষ হলে আর-একটি নগর জেগে ওঠে। বিজয়ী রাষ্ট্র-পুরুষ সবচেয়ে সুন্দরীকে অশ্বে তুলে নিয়ে চলে যায়।