রিবিকার বুকের দিক থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছিল না। তার কুসুকুলিকার মত রাঙা আঙুল স্তনের প্রলিপ্ত প্রজাপতির ডানাকে ছুঁয়ে তুলে ফেলে উড়িয়ে দেবার আকাঙ্ক্ষা করে–এই মুহূর্তে। এই মনোভাব কোন মসীহ বা ঈশ্বর জানতে পারে না। মানুষ সে অর্থে দেবতার চেয়ে দুর্গম।
রিবিকা সাদইদকে ভুল বুঝল। মনে হল, চোখে যতই দয়া থাক, এ নিশ্চয়ই এমন নির্জনতায় সম্ভোগ না করে ছাড়বে না। মসীহ যদি সহায় থাকেন, সম্ভোগের পর ছেড়ে দেবে। তখন সে মরুপথে কেঁদে বেড়াবে, তাই বেশ । তবু নিস্তার পাবে। মহাত্মা ইহুদকে সে কি পাবে না খুঁজে? সাদইদের গালে চড় মেরে বলল–অনেক দেখেছ, দেবদাসী দ্যাখোনি, না? কোন পুরুষের হৃদয়ে যুদ্ধের যুগে সত্য নেই সরদার। পুরুষ যে কখনও সত্য সৃষ্টি করেছে, ঈশ্বরের প্রত্যাদেশে করেছে, তেমন দুএকজন ছাড়া আমার কে আছে? নাও, যা করবার করো। তুমি আমার মেষশিশুকে মেরেছ! প্রাণের উপর খুব মায়া তাই না, প্রজাপতির বন্ধু!
বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দুহাতে মুখ ঢেকে সাদইদের পায়ের কাছে মাটির উপর বসে পড়ল রিবিকা। কান্নার চাপে তার বুক ভেঙে যেতে লাগল। শরীর কাঁপতে লাগল।
সাদইদ কিছুক্ষণ হতভম্বের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে ধীরে ধীরে কান্না থেমে গেল রিবিকার। কান্নাভেজা দুহাত চোখের উপর থেকে সরিয়ে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদইদকে দেখল। তারপর গায়ের কাপড় সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
এবার সাদইদ খুশি হয়ে উঠল অকারণ। বলল–ওঠো! আমি লাগাম ধরে হেঁটে যাব।
রিবিকা প্রথমে সাদইদের প্রস্তাব ঠিক শুনছে কিনা বুঝতে পারছিল না। হাসি মুখে খুব নরম করে সাদইদ বলল–উঠবে না? জিজ্ঞাসা করেই সে তার আঙুলে লেগে থাকা প্রজাপতির পাখার আসান লক্ষ্য করছিল। কিছুই থাকে না। একটি নগরী আঙুলের এই রেণুর মত শেষ হয়। তাই কি? কিন্তু আমি কখনই একথা মানতে পারি না। মনে মনে বলল সাদইদ।
রেকাবে পা রেখে বহুকষ্টে রিবিকা ঝুলে ঝুলে বেয়ে বেয়ে ঘোড়ার পিঠে। উঠল। সামনে লাগাম ধরে এগিয়ে চলল সাদইদ। অনেকক্ষণ দু’পক্ষই নীরব।
হঠাৎ সাদইদ মিশরীয় সেই কবিতা আউড়ে উঠল আপন মনে :
‘আমার ফুলের বাজার, তাই খদ্দের আসে না।
আমার নেই পশম, যা দিয়ে তোমায় রক্ষা করি,
ওহে প্রিয়া! মরুশীতে একটি বৃদ্ধ উট
আমার সঙ্গী! আতর আর সুর্মা কী হবে!
শুধু পশমের জন্য, আঙুর বাগিচার জন্য,
সবুজ উপত্যকার জন্য এ জীবন–আব্রাহাম!’
চমকে ওঠে রিবিকা! সে চুপিচুপি বুকের কাপড় সরিয়ে দেখে দুটি প্রজাপতিই স্পন্দনহীন। এ-স্থল ছুঁয়েছে ওই লোকটি!
কবিতার সুর সহসা সাদইদের গলায়।
সাদইদ বলল–তোমার এই ভেড়ার বাচ্চাটা যদি আমাদের শিবিরে না ঢুকে পড়ত, তাহলে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হত না। ভেড়াটাকে দেখেই মনে হল, রাস্তায় নিশ্চয়ই কোন কাফেলা (মরুযাত্রীদল) যাচ্ছে। আমার সৈন্যরা যে যেমন পারল এদিক-ওদিক ছড়িয়ে গেল ঘোড়া নিয়ে, মরুভূমির মধ্যে। আমি একা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আসছিলাম। তোমাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখে কী যে হল বলতে পারব না–কোলের বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিলাম, ওর পিঠে চাপিয়ে দিলাম আমার ঘাড়ের কাপড়। ওকে এভাবে বর্শায় গেঁথে মারার আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিল না।
–তবে মারলে কেন? উদ্বেগের সঙ্গে বলল রিবিকা।
সাদইদ বলল–হিত্তীয় সৈনিকদের সম্বন্ধে তোমার কোন ধারণা নেই। ওরা ক্ষ্যাপা কুত্তার মত মরুভূমি তোলপাড় করে যখন কিছুই পাবে না–জুমা পাহাড়ের ওদিকে ঘোড়া হাঁকিয়ে চলে গিয়ে মদ খেয়ে দেবদাসীদের মন্দিরে পড়ে থাকবে দুদিন। যুদ্ধ যত ঘোরতর হয় দেবদাসীদের উপর ততই নির্যাতন বাড়ে। যুদ্ধের আধেক শক্তিই দেবদাসী। বিশেষ করে আমারনার মেয়েদের উপর বেশি লোভ।
–কেন?
–তারা সুন্দরী আর ওদের হাত-পা মোলায়েম। মিশর সুখী দেশ। চাষী ঘরে যারা মাঠে কাজ করে তারা গেঁয়ো হয় ঠিকই, হাত-পা শক্ত হয়, কিন্তু শহুরে দেবদাসীরা কামকলায় পটু আর লেখাপড়াও কিছুটা জানে, গান জানে। ওখানকার অভিজাতরা দেবদাসীদের যত্নে রাখে। একটা রাষ্ট্র কতটা ভাল তা বোঝার উপায় হচ্ছে দেবদাসী। যেখানে কবিতা-চৰ্চার চেয়ে কামকলার চর্চা বেশি হয়, জানবে সেটা ঐশ্বর্যশালী দেশ। কবিতা হল উটচালকের জিনিস, তারা তো চুটকিলা গায়, ঠুংরি জাতীয় গান করে।
–তুমি কী করো! সকৌতুকে জানতে চায় রিবিকা!
–আমি? বলে স্নান হেসে পিছনে ফিরে চাইল সাদইদ। তারপর সামনে চোখ মেলে চলতে চলতে বলল–আমি কী করি একটু পরেই বুঝতে পারবে। অকৃতজ্ঞতা হল যুদ্ধের শর্ত? তোমার ভেড়ার ওপর আমার কোনই কৃতজ্ঞতা ছিল না। থাকলে হত্যা করতাম না। আমি শিবিরে গিয়ে কোন কথাই বলব না, শুধু ভেড়াটা ছুঁড়ে দেব। একটা ভেড়া আর তোমার মত সুন্দরীকে পেলে ওরা চুড়ান্ত উৎসাহ পাবে। আমি ওদের পরিচালক। ওরা মরুভূমি ছুঁড়ে খালি হাতে ফিরেছে। ব্যর্থতার জ্বালায় জ্বলছে। আমি ওদের প্রশমিত করব। ওদের বোঝাতে হবে, রেগে উঠলেই হয় না, চোখ খুব তীক্ষ্ণ আর মাথাটা ঠাণ্ডাও। দরকার।
–তুমি আমাকেও ভেড়াটার সঙ্গে হত্যা করলে না কেন? অশ্বপৃষ্ঠে হাহাকার করে উঠল রিবিকা।
–মানুষ যে যুদ্ধে জেতে কেন জেতে, তলার ইতিহাস খুব কটু। একজন মহাপরিচালকের পক্ষে খারাপ দেখালেও তাকেও কতকগুলো ছোট কাজ করতে হয়। ভেড়া বওয়াটা নিশ্চয় খুব মর্যাদার কাজ নয়। তবু কেন বইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ।