আবীরুদের সঙ্গে খুব স্বল্প সময় রিবিকা একটি তাঁবুতে বাস করেছিল। এই জীবন যাপনের কোন মানে হয় না। আবীরুদ তাকে কোনদিনই ঘরে তুলতে পারত না। নমরু এই সম্পর্ক স্বীকার করবে কেন? মরু-যাযাবরের মত আবীরুদ তাঁবুতে দিন কাটাত-সঙ্গে সুন্দরী রিবিকা। এলিফেনটাইনের (ঐরাবত মন্দিরের) অধিবাসীরা তাদের সন্দেহের চোখে দেখত। এই জীবন কোনদিই মিশরের মাটিতে প্রতিষ্ঠা পাবে এমন সম্ভাবনা ছিল না। তবু সেই তাঁবুর জীবনে আকাশে মরু-চাতকের করুণ স্বর কখনও থামেনি।
লোকে আবীরুদকে ঠাট্টা করে বলত–অমন সুন্দর প্রাসাদ ছেড়ে ছেলেটা ওই পূর্বদেশী একটা ইস্তারীকে নিয়ে পড়ে আছে! দেবদাসীকে ঘরে তোলার সাধ্য তো নেই। আমনের বউকে গৃহ দিতে নেই, সে মন্দিরের সরকারী মাল । ছোঁড়াটা দু’দিন মধু লুটছে। আসলে ঘেন্নাপিত্ত থাকলে আমারনা থেকে পালিয়ে আসে-সঙ্গে একটা উটমুখী মেয়ে। হায়, একেই বলে ভ্যাগাবন্ডী! জীবনে হুতোশ লাগলে কে ঠেকায়!
ফেরাউনদের শবাধারলিপিতে খোদিত ছিল :
‘আমি কাউকে কখনও কাঁদাইনি,
কাউকে কষ্ট দিইনি। কখনও কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিইনি।’
মিশর রিবিকাকে কেবলই কাঁদিয়েছে। আবীরুদকে মেরেছে। চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে অশ্বারোহণের উদ্দাম চঞ্চল বেগবতী স্মৃতিই রিবিকার দহ্মানো জীবনকে আরো দন্ধেছে। জীবনের কোথাও সে আশ্বাস পায়নি জন্মাবধি। তার দেহে। খেজুর রসের নবীন স্বাদু ঘ্রাণ মিশরীয় আতরে মজ্জিত হয়েছে মাত্র–সেই সজ্জা, সেই রাতের গভীর উত্তেজক যাত্রা তাকে কাঁদায়।
ইহুদ তার পিঠে হাত রেখে মন্দ্রস্বরে বলেছিলেন–একটি মেষশাবক তোমায় পথ দেখাবে রিবিকা। সেই তোমার নিয়তি। কারণ মাসি সেই বাচ্চা মেযেদের ভালবাসতেন।
রিবিকা আবার ভেড়ার বাচ্চাটির দিকে হাত বাড়াল। তার হাসি পাচ্ছিল স্বপ্নদর্শী ইহুদ অদ্ভুত কথা বলেন। তাঁর পয়গম্বরী রহস্যময়। তিনি স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা একটি পবিত্র দেশের কথা বলেন। মর্তের এক অমরাবতী সেই কনান। মধু আর দুধ বইছে তার মাটিতে, উপত্যকায় স্বর্ণশস্যে ম ম করছে হাওয়া।
এই সংগীতময় অরণ্যের মর্মর ব্যঞ্জিত সুঘ্রাত হাওয়া এসে রিবিকার নগ্ন ত্বকে স্পর্শ দিচ্ছিল। সমস্ত রাত্রির জাগরণের ক্লান্তি দু চোখে ঘুমের আবেশ এনে দিয়েছিল, সে আর চোখ তুলে চাইতে পারছিল না। তথাপি সে জোর করে দু চোখ প্রসারিত করল। ভেড়ার বাচ্চাটিকে ধরবার জন্য ছুটে গেল। বাচ্চাটি অরণ্যের ভিতর ছুটে যেতে লাগল।
রিবিকা অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করেছিল। সে আর ভেড়াটিকে দেখতে পেল না। স্বপ্নদশী ইহুদের কথা কি সত্য? তাই যদি হবে তাহলে এই অরণ্যে পথ কোথায়? সে তো পথ হারিয়ে ফেলেছে। এ অরণ্য আর যাই। হোক নিরাপদ নয়। মনে হচ্ছিল হিংস্র জন্তু রয়েছে, ডাকাতদল থাকতে পারে। যে-নারীর জীবনের দাম মাত্র তিনটি ভেড়ার লোমের ওজনের সমান–তাকে একটি মেষশাবক পথ দেখাবে কী করে? ইহুদ তাঁর ধর্মের প্রতীক মেষের কথা বলেছেন। মেষশিশু মানে সেই মসীহ, সীনয় পাহাড়ে যাঁর ঈশ্বরের সঙ্গে কথা হয়েছিল। মুসা, মোসি, মসীহ।
হঠাৎ শিঙার আওয়াজ কানে এল রিবিকার। সে উৎকর্ণ হয়ে উঠল । আবোরা প্রবেশ করল ভিতরে। চোখে পড়ল তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি ভূমিক্ষেত্রে লোজন রয়েছে, তারা সৈনিকের পোশাক পরা এবং বিচিত্র রঙের বলিষ্ঠ অশ্ব চিৎকার করছে। রিবিকা ভয় পেয়ে পিছনে ফিরল এবং দ্রুত দৌড়তে লাগল। মেষশাবককে নিকটে আকর্ষণ করে। বস্ত্রখণ্ড তুলে নেয়। তার বুকে প্রজাপতির ডানা মৃদু স্পন্দনে যেরকম তার শ্বাসপ্রশ্বাস যেন সেই ছন্দে স্পন্দিত। কিন্তু তবু সে এই জীবনকে বিশ্বাস করতে পারে না।
প্রজাপতি দুটি তার বুক থেকে উড়ে পালাবার ক্ষমতা রাখে না। ক্রমে মৃত্যুই স্বাভাবিক। মধুর লোভে যে এই দুটি প্রাণ এসেছিল তা সে বুঝতে পারে উপরে চোখ তুলে। বিরাট কালো মধুচক্র। যেন মেঘ। ক্ষুদ্র পিরামিড উল্টো করে। ঝোলানো, যেন ঝুলন্ত শিলা। টুপিয়ে পড়া মধু মৃত্যুসোমরস। কী বোকা রে তোরা! নারীর বুকের এই পুষ্পফুল্লতা মায়াবী, এ যে পুষ্পভ্রম মাত্র! যদি আক্কাদ। কখনও নারীর বুকে চন্দ্রোদয় দেখত অথবা পুষ্পকলিকার বিকাশ লক্ষ্য করবার প্রতিভা পেত! একজন মরুবণিক তা পারে না। তার তো মদ আর শুঁটকির কারবার। মরুর রঙ ধূসর। দামাস্কাস থেকে ফোরাতের তীরে বাসা বেঁধেছিল ঐশ্বর্যের লোভে কারবার ফলাবার জন্য। বোকা চাষীদের ঠকিয়ে মুনাফা করার জন্য। তার চোখে মেয়েমানুষ খরিদা সম্পত্তি, যুদ্ধে পরিত্যক্ত মাল। সে কখনও মিশরের শৃঙ্গার রসের কবিতা পড়েনি।
‘নারী তুমি মেষপশমের মত হালকা
তোমার দাম নেই, ওজন নেই–
তবু তোমাকে ফুলের বিনিময়ে খরিদ করা যায় না।
মরুশীতে উষ্ণপশম দিতে পারিনি প্রিয়া–
আতর আর সুর্মা তাই বৃথা গেছে। আমার তো
ফুলের বাজার–খদ্দের আসে না ।।’
ভূপতির ছেলে আবীরুদের মেজাজ আতর আর সুর্মার মেজাজ। কিন্তু প্রিয়ার জন্য শীতের পশম কেনার সামর্থ্যও তার ছিল না। তাঁবুর জীবনে পশুর লোম যোগাড় করা সমস্যা, কিন্তু সেই দুঃখকে সে সস্তা আতরে আর সুর্মায় এবং ফুলে ভরিয়ে তুলেছিল। অন্তত তার মুখের কবিতায় তার দারিদ্র্য আর বাদশাহীপনা। একাকার হয়ে যেত। বস্ত্রখণ্ড গায়ে জড়াতে জড়াতে সেই কবিতার সুর কানে ভেসে আসছিল স্মৃতির ধুনে। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল রিবিকা।