একসময় সে অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বন্ধুদের বেশির ভাগ এইসময় দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি পালাতে পারছি না, কারণ সবকিছুর মূলে আমি। আমার অসহায় মুখ দেখে খালেকুজ্জামানও পালাল না। আমরা দুজন অনেক কষ্টে চিশতিকে টেনে টেনে করতোয়া নদীর পাশে নিয়ে আসি। তার চোখেমুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরাই। জ্ঞান ফেরার পর চিশতি বলে, ভয়ঙ্কর একটা মানুষের মতো প্রাণী দেখে সে জ্ঞান হারিয়েছে। এই প্রাণীটা তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিল?
আমি এবং খালেকুজ্জামান ভয়ে অস্থির হয়ে গেলাম। চিশতির অসীম সাহস। সে আমাদের দুজনকেই বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজে একা ফিরে গেল শ্মশানঘাটে। অদ্ভুত প্রাণীটার সঙ্গে সে কথা বলবে।
ঐ রাতের ঘটনার পর থেকে চিশতির মনোজগতে একটা স্থায়ী পরিবর্তন হয়ে গেল। সে প্রায়ই একা শ্মশানঘাটে বসে থাকত। সে আমাকে বলেছে প্রাণীটার সঙ্গে তার কথা হয়েছিল। কী কথা হয়েছিল তা আমাকে বলে নি।
আমার পর চক্র নিয়ে উৎসাহিত হলো আমার ছোটভাই জাফর ইকবাল (লেখক, বিজ্ঞানী এবং আরও অনেক কিছু)। সে থাকে ফজলুল হক হলে। পড়ে Physics. প্রায়ই শুনি সে বন্ধুদের সঙ্গে চক্রে বসছে। ভূত-প্রেত নামাচ্ছে। এক রাতে ঘটনা তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। (কী হয়েছিল পরিষ্কার না) তারা বাধ্য হলো হলের মাওলানা সাহেবকে ডেকে আনতে। মাওলানা তাদের ঘরে পা দিয়েই আঁতকে উঠে বললেন, কী সর্বনাশ! আপনারা তো জ্বিন নামিয়ে ফেলেছেন! কীভাবে নামালেন?
জাফর ইকবাল তার বই রঙিন চশমা-তে ঘটনাটির বিশদ বর্ণনা দিয়েছে।
এখন আমি বিশেষ এক চক্রের পূর্ণ বিবরণ দিচ্ছি, তবে কেউ যেন এই ঝামেলায় না জড়ান তার জন্যে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। ভূত-প্রেত নামুক বা না-নামুক, এই পদ্ধতি এক ধরনের হিপনোটিক অবস্থার সৃষ্টি করবে। দৃষ্টিভ্রান্তি (Halliocination) ঘটার সমূহ সম্ভাবনা।
প্রস্তুতি
১. নয়জন সমবয়সী মানুষ একত্রিত হবেন (নয় সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ।
২. পাঁচজন ছেলে এবং চারজন মেয়ে।
৩. সবাইকে স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরতে হবে। শরীরে সুগন্ধি দেবেন। গলায় মিষ্টি গন্ধের ফুলের (বেলী, গন্ধরাজ, কামিনি) মালা পরবেন।
৪. পরিষ্কার করা (কয়েকবার ন্যাকড়া দিয়ে মোছা) একটি ঘরে সবাই একত্রিত হবেন। কর্মকাণ্ড শুরু হবে মধ্যরাতের পর যখন চারদিক নীরব হয়ে আসবে।
৫. ঘরের চার মাথায় চারটা মোমবাতি জ্বালাবেন।
৬. দরজা জানালা বন্ধ করে দিতে হবে যাতে বাতাসে মোমবাতি নিভে না যায়।
৭. ঘরের বাইরে উৎসুক কোনো দর্শক থাকতে পারবে না।
৮. মহিলা সদস্যরা চুড়ি পরবেন না। চুড়ির টুং টাং শব্দে সমস্যা হবে।
৯. সবাই থাকবেন খালি পায়ে।
১০. ভরাপেটে চক্র করা যাবে না। সামান্য খাদ্য গ্রহণ করা যেতে পারে। ফলমূল দুধ। এর বেশি কিছু না।
পদ্ধতি
১. একজন ছেলে একজন মেয়ে—এইভাবে সবাই গোল হয়ে দাঁড়াবেন।
২. সবাই পাশের জনের হাত ধরে চক্র বানাবেন। চক্র কোনো অবস্থাতেই ভঙ্গ করা যাবে না, অর্থাৎ হাত ছাড়া যাবে না।
৩. এখন নাচের ভঙ্গিতে সবাই কেন্দ্রের দিকে আসবেন এবং আগের জায়গায় ফিরে যাবেন। এরকম চলতে থাকবে যতক্ষণ না সবাই খানিকটা ক্লান্ত এবং অবসন্ন। পনের বা কুড়ি মিনিট। এই সময় কেউ কোনো কথা বলবেন না। ফিসফিস করেও না।
৪. এখন মূল অংশ। চক্র বড় করে ঘুরতে শুরু করবেন। chanting (জিকির) শুরু হবে। ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বলতে হবে, আয় আয় আয়। যখন ছেলেরা বলবে তখন মেয়েরা চুপ করে থাকবে। যখন মেয়েরা বলবে তখন ছেলেরা চুপ করে থাকবে। ঘূর্ণনপ্রক্রিয়া (নাচের ভঙ্গিতে) চলতেই থাকবে।
এইসময় একটা দুটা মোমবাতি বা সবকটি মোমবাতি নিভে যেতে পারে, আবার নাও নিভতে পারে।
চক্র সফল হলে চক্রের মাঝখানে অলৌকিক উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। তাকে প্রশ্ন করলে সে উত্তর দেবে।
যারা চক্র করছে তাদের কেউ গাঢ় আবেশে অজ্ঞান হয়ে পড়লে চক্র বন্ধ করে দিতে হবে। জ্ঞান ফেরানোর জন্যে চোখেমুখে পানির ছিটা দেওয়া যেতে পারে বা স্মেলিং সল্টের গন্ধ শোকানো যেতে পারে।
কৃষ্ণশক্তির আরাধনা বা পরলোকের অনুসন্ধানে নৃত্য একটি বিশেষ অনুসঙ্গ। কেন এরকম তা জানি না। মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি সুফিসাধনার সূত্রপাত করেন। এই সাধনায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বাইরের জগতের অনুসন্ধান করা হয়।
সুফিসাধকরা শুরুতে তাদের ডানহাত যেখানে পণ্ড তার উপর রাখেন। ডানহাতের উপর ক্রশ করে বাঁ হাত রাখা হয়। তারা সবাই দাঁড়ান বা পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে। একসময় ঘুরতে শুরু করেন। পৃথিবী যেমন তার অক্ষের উপর ঘুরে সেরকম ঘূর্ণন। তারা এইসময় জিকির শুরু করেন (আল্লাহু)। বেশকিছু সময় ঘূর্ণনের পর সমবেত নাচ শুরু হয়। তারা প্রবেশ করেন তাদের দাবি) অন্য এক অপার্থিব ভুবনে।
ক্রিশানদের মধ্যেও একসময় এই ধরনের নাচের প্রচলন ছিল। St. Jhon তার বর্ণনা দিয়েছেন। নাচের সময় সুর করে বলা হতো–
And we all circled round him and responded to him; Amen. The twelfth of the numbers pales the round aloft; Amen to each and all it is given to dance, Amen.* (*The Mystic Sprial; Jilt Pruce. Thames and Hudon.)
ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পবিত্র কাবা শরীফের চারদিকে ঘুরেন। আরবিতে এই ঘূর্ণনকে বলে tafa. এর অর্থ to attain the summit of a thing by spiraling round it.