মেয়ের বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে?
না, মেয়ের বোনের বাসায়। মেয়ের বাবা-মা নেই। বড় বোন মানুষ করেছেন। উনার বাড়িতেই বিয়ে হচ্ছে।
তুই কি ঐ বাড়ি চিনিস?
না-মা।
চেনা থাকলে ভাল হত। সরাসরি ঐ বাড়িতে চলে যেতে পারতিস। বরযাত্রী নিশ্চয়ই এর মধ্যে রওনা হয়ে গেছে . . .।
চশমা মনে হচ্ছে পাওয়া যাবে না, মা!
অবশ্যই পাওয়া যাবে। কোথায় কোন ফাঁকে পড়েছে। তোকে আরো সাবধান হতে হবে, শুভ্ৰ।
শুভ্ৰ হাসল। কি সুন্দর করে ছেলেটা হাসে। যতবার দেখেন ততবার রেহানার বুক ধক করে উঠে। পুরুষ মানুষকে এত রূপবান হতে নেই। শুভ্র বলল, মা, আমি ছাদে গিয়ে বসব। তুমি আমাকে ছাদে দিয়ে এসো।
আমি বরং চশমার দোকানে টেলিফোন করে দেখি।
লাগবে না মা। আমার এখন আর যেতে ইচ্ছা করছে না। তুমি আমাকে ছাদে দিয়ে এসো।
রেহানা শুভ্রকে হাত ধরে ধরে ছাদে তুলে দিলেন। শুভ্র বলল, তুমি চলে যাও। আমি এক এক ছাদে হাঁটব।
ভয় পাবি তো!
ভয় পাব কেন?
রেহানা নিচে নেমে গেলেন। তাঁর নিজেরও মন খারাপ লাগছে। শুভ্রর সামান্যতম কষ্টও তাঁর বুকে এসে লাগে। তিনি নিজের শোবার ঘরে ঢুকে তাঁর দূর সম্পর্কের বোন রিয়াকে টেলিফোন করলেন। বিয়া খুব আমুদে মেয়ে। ও এসে হৈচৈ করে শুভ্রর মন ভাল করে দেবে। ও বাসায় আছে কিনা সেটাই কথা। রিয়ার বরও হয়েছে। রিয়ার মত। দিন রাত চরকিপাক খাচ্ছে। রিয়ার বরের সঙ্গে বাইরে থাকার কথা।
রিয়াকে পাওয়া গেল। রেহানা বললেন, কি করছিস রিয়া?
রিয়া হাসতে হাসতে বলল, ছটফট করছি।
ছটফট করছিস কেন?
আজ রাত বারোটায় আমাদের বাড়িতে ভূত নামানো হবে। এই টেনশনে ছটফট করছি।
ভূত নামানো হবে মানে কি?
সুইডেন থেকে জামানের এক বন্ধু এসেছে। ও না-কি ভূত আনার ব্যাপারে এক্সপার্ট। খুব ভাল মিডিয়াম। তা তুমি হঠাৎ টেলিফোন করেছ কেন?
এম্নি।
এমি তুমি কখনো টেলিফোন কর না। কারণটা দয়া করে বলে ফেল।
শুভ্রর জন্যে খারাপ লাগছে।
কেন! ওর কি হয়েছে?
ওর মন খারাপ, বন্ধুর বিয়েতে যাবার কথা ছিল। যেতে পারেনি। চশমা হারিয়ে ফেলেছ।
চশমা হারানো তো ওর নতুন ঘটনা না। সব সময় হারাচ্ছে। গতবছর পিকনিকে গিয়ে চশমা হারিয়ে ফেলল। আমরা কত হৈচৈ করছি আর সে উবু হয়ে খুঁজেছে চশমা। বুকু, তুমি এক কাজ কর–দুতিন হাজার চশমা কিনে রঙিন সুতা দিয়ে ঘরের বিভিন্ন জায়গায় ঝুলিয়ে রাখ।
রেহানা হাসলেন। রিয়া বলল, হাসি না, আমি সত্যি সত্যি বলছি। শুভ্ৰ এখন কি করছে–চশমার শোকে দরজা বন্ধ করে কাঁদছে?
ছাদে হাঁটছে।
আমাকে টেলিফোন করার উদ্দেশ্য কি এই যে আমি এসে ওকে নিয়ে মন ভাল করে ফেরত দেব?
না থাক, তোর প্রোগ্রাম আছে।
প্রোগ্রাম কিছু না। ভূতের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট। মানুষের এ্যাপয়েন্টমেন্ট যেমন বাতিল করা যায়, ভূতেরটাও যায়। আমি এসে ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আর শোন, তুমি
কি শুভ্রের বিয়ে-টিয়ে দেবার কথা ভাবছ?
মাত্র তো পাশ করল।
ওর বয়স এখন কত যাচ্ছে–চব্বিশ না?
সাতাশ।
কি সর্বনাশ! বিয়ের বয়স তো চলে যাচ্ছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। আমার চেনা একটি মেয়ে আছে। আমার মতই রূপবতী। বিহারী মেয়ে। বিহারী হলেও বোঝার উপায় নেই। বাঙালি কালচার ধরে ফেলেছে। রবীন্দ্র সংগীত গায়। জীবনানন্দের কবিতা পড়ে।
বাঙ্গালী মেয়ের কি দেশে অভাব?
রূপবতী মেয়ের অভাব তো আছেই। তুমি আমার মত আরেকজন খুঁজে বের কর–আমি তোমাকে এক হাজার টাকা দেব। শুভ্রকে তো আর যার-তার সঙ্গে বিয়ে দেয়া যাবে না। তার পাশে রাজকন্যা লাগবে। যাই হাক, বুকু, তুমি শুভ্রকে তৈরি হতে বল। আমি আসছি। বিহারী মেয়েটির একটা ছবি আমার কাছে আছে। আসার সময় কি নিয়ে আসব?
তুই নিজে আয়। ছবি-টবি কিছু আনতে হবে না।
শুভ্ৰ তাদের ছাদের ঠিক মাঝখানে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ আকাশের দিকে। তবে চোখ বন্ধ। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার কি মানে রেহানা বুঝলেন না। তিনি ডাকলেন, এই শুভ্ৰ!
শুভ্ৰ মার দিকে তাকাল। রেহানা আনন্দিত গলায় বললেন, এই নে চশমা। পাওয়া গেছে। বারান্দায় যে ফুলের বড় টবটা আছে–ঐ টবের পেছনে পড়ে ছিল। শুভ্ৰ মার হাত থেকে চশমা নিতে নিতে মৃদু স্বরে বলল, থ্যাংকস মা। রেহানা বললেন, আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না–চশমা ঐ খানে কিভাবে গেল।
পাওয়া গেছে এটাই বড় কথা।
মাঝখান থেকে তোর যাত্রা নষ্ট। আর ঘণ্টা খানিক আগে পাওয়া গেলে কি ক্ষতি হত! তোর মন নিশ্চয়ই খারাপ।
না মা। মন ঠিক করে ফেলেছি।
কিভাবে ঠিক করলি?
আমার মন ঠিক করার কিছু নিজস্ব টেকনিক আছে।
আমাকে শিখিয়ে দে। আমারো তো প্রায়ই মন খারাপ থাকে।
আমার টেকনিক কাউকে শেখানো যাবে না। উদ্ভট সব টেকনিক। শুনলে তুমি ভাবাবে আমার মাথা খারাপ।
তোর মাথা খানিকটা খারাপ তো বটেই। শোন শুভ্ৰ, তোর রিয়া খালা আসছে। তুই তার সঙ্গে ঘুরে আয়। তোর ভাল লাগবে।
ছাদে ঘুরতেই আমার ভাল লাগছে, মা।
তুই কাপড়-চোপড় পরে সুন্দর করে সেজে বসে আছিস–রিয়ার সঙ্গে ঘুরে আয়। তোর ভাল লাগবে।
আমি যাব না, মা। আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
দুজন ছাদ থেকে নেমে আসছে। রেহানা বললেন, আমার হাত ধর। হাত ধরে ধরে নাম।
হাত ধরতে হবে না, মা। এখন চোখে চশমা আছে, সব দেখতে পাচ্ছি।
চশমা থাকলে বুঝি আর মার হাত ধরা যায় না!
শুভ্র মার হাত ধরে থমকে দাঁড়াল। নিচু গলায় বলল, মা, তুমি আমার চশমাটা লুকিয়ে রেখেছিলে, যাতে আমি আমার বন্ধুর বিয়েতে যেতে না পারি। তুমি চাও না আমি আমার দরিদ্র বন্ধুদের সঙ্গে মিশি। ওরা কিন্তু মা, আমাকে খুব পছন্দ করে। আমিও ওদের পছন্দ করি। তোমাকে যতটা করি ততটা করি না, কিন্তু করি….