শুভ্রর ইচ্ছা করছিল আরো খানিকক্ষণ হাঁটতে, কিন্তু সময় নেই। আজ জাহেদের বিয়ে। সন্ধ্যা মেলাবার পরপর বরযাত্রী রওনা হবে। শুভ্র বরযাত্রীদের একজন। সে মাইক্রোবাস নিয়ে যাবে। তার দেরি করার সময় নেই। শুভ্র ঘরে ঢুকাল। চশমা খুঁজে পেল না। বিছানার পাশে এই সপ্তাহের টাইম পত্রিকা পাতা খোলা অবস্থায় আছে। পত্রিকার পাশে এক প্যাকেট ক্যাসো নাট। প্যাকেট খোলা হয়নি। বালিশের নিচে তার নাটবুক এবং পেনসিল। সবই আছে, চশমা নেই। শুভ্ৰ তার শরীরে এক ধরনের কাঁপুনি অনুভব করল। চশমা হারালে তার এ রকম হয়। মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নিজেকে এত অসহায় লাগে! মনে হয় অচেনা অজানা দেশের হাজার হাজার মানুষের মাঝখানে সে হারিয়ে গেছে। চোখে দেখতে পাচ্ছে না, কথা বলতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারে অসংখ্য মানুষ তাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। সে যেমন ওদের দেখতে পাচ্ছে না, ওরাও তাকে দেখতে পাচ্ছে না। সে ওদের কাছে অদৃশ্য মানব।
শুভ্ৰ আতংকিত গলায় ডাকল, মা! মা!
রেহানা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এলেন। শুভ্ৰ ভাঙা গলায় বলল, আমার চশমা খুঁজে পাচ্ছি না, মা।
তার চিৎকার শুনেই বুঝেছি। শান্ত হয়ে বস তো এখানে। চশমা যাবে কোথায়? ঘরেই আছে। চশমার তো পাখা নেই যে উড়ে ঘর থেকে পালিয়ে যাবে।
বালিশের কাছে রেখেছিলাম।
বালিশের কাছে রাখলে, বালিশের কাছেই আছে।
রেহানা বিছানায় কোন চশমা দেখলেন না। খাটের নিচে পড়েছে বোধহয়। তিনি দ্রুত খাটের নিচটা দেখে নিলেন। শুভ্র বলল, মা, পাওয়া গেছে?
পাওয়া যাবে। তুই চুপ করে বসে থাক তো। ঘামতে শুরু করেছিস।
সন্ধ্যা মেলাবার সঙ্গে সঙ্গে বরযাত্রী রওনা হবে।
চশমা এক্ষুণি পাওয়া যাবে। তুই যথাসময়ে যেতে পারবি। তাছাড়া বরযাত্রী কখনা সময়মত রওনা হতে পারে না। এক ঘণ্টা-দুঘণ্টা দেরি হবেই।
মা, তুমি কথা বলে সময় নষ্ট করছ। আমার খুব অস্থির লাগছে।
শুভ্রর আসলেই খুব অস্থির লাগছে। অন্যসময় এতটা অস্থির লগত না। কারণ তখন শুভ্ৰ জানত জরুরি অবস্থার জন্যে দুটা চশমা কাবার্ডে লুকানো আছে। আজ সেই চশমা দুটি নেই। শুভ্রর চোখ আরো খারাপ হওয়ায়–ঐ চশমা দুটিতে নতুন গ্লাস লাগানোর জন্যে দোকানে পাঠানো হয়েছে। ভেরিলকি লেন্স লাগানো হবে। এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
মা, পাওয়া গেছে?
এখনো পাওয়া যায়নি। তবে পাওয়া যাবে। চশমা খুলে রেখে তুই কোথায় কোথায় গিয়েছিস বল তো?
কোথাও যাই নি। বাথরুমে গিয়ে চোখে পানি দিয়েছি।
তাহলে চশমা বাথরুমেই আছে। তুই হাতে করে নিয়ে বেসিনের উপর রেখে চোখে পানি দিয়েছিস। তারপর চশমার কথা ভুলে গেছিস।
রেহানা বাথরুমে ঢুকলেন। চশমা সেখানে নেই। তিনি রারান্দায় গেলেন। বারান্দায় ছোট একটা টেবিল আছে। শুভ্ৰ মাঝে মাঝে ঐ টেবিলে চশমা রেখে ভুলে যায়–আজও নিশ্চয়ই তাই হয়েছে।
বারান্দার টেবিলে কিছু নেই। তিনি আবার শোবার ঘরে ঢুকলেন। চিন্তিত এবং ব্যথিত মুখে শুভ্র বসে আছে। তার ফর্সা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শুভ্র বলল, কি হবে মা!
কিছু হবে না। পাওয়া যাবে। তুই আমার সঙ্গে বারান্দায় এসে বস তো দেখি। আর আমরা দুজন চা খাই। আমি কাজের লোকদের বলছি। ওরা খুঁজে দেবে।
আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে না, মা।
তুই এত অল্পতে অস্থির হাস কেন বল তো?
চশমা ছাড়া আমি অন্ধ। অন্ধ হওয়াটা কি খুব অল্প?
ইস ঘেমৌ-টেমে একেবারে কি হয়েছিস! আয় আমার সঙ্গে।
তিনি শুভ্রকে হাত ধরে বারান্দায় এনে বসলেন। দোতলা থেকে একতলায় নেমে বাবুচকে বললেন খুব ভাল করে দুইেকাপ চা বানাতে। কাজের মেয়ে শাহেদা এবং কাজের ছেলে তোতামিয়াকে দাতলায় এসে শুভ্ৰকে চশমা খুঁজে দিতে বললেন। এ রকম কখনো করা হয় না। এ বাড়ির কাজের লোকদের কখনো দোতলায় আসতে দেয়া হয় না। ওদের কর্মকাণ্ড একতলাতেই সীমাবদ্ধ। দোতলার যা কাজ রেহানাই করেন। তাঁর শূচিবায়ুর মত আছে।
শুভ্র বলল, কটা বাজে মা?
খুব বেশি বাজে নি। মাত্র ছটা। তুই কাপড় পরে তৈরি হয়ে থাক। ড্রাইভারকে বলি মাইক্রোবাস বের করে রাখতে। তুই আমার সঙ্গে বসে চা খাঁ। বোকা ছেলে! এত অল্পতে এমন নাভস হলে চলে?
আমার দেরি হলে জাহিদ খুব অস্থির হয়ে পড়বে। আজ ওর বিয়ে। আজ কি ওকে অস্থির করা উচিত?
তোর দেরি দেখলে ও অস্থির হবে কেন?
ও তো কোন গাড়ি-টারি জোগাড় করতে পারে নি। আমাদের মাইক্রোবাসটা ওর ভরসা। এটাকেই ফুল-টুল দিয়ে সাজিয়ে বরের গাড়ি করা হবে।
তাহলে বরং এক কাজ করা যাক। মাইক্রোবাসটা পাঠিয়ে দেয়া যাক। তুই চশমা পাওয়ার পর আমার ছোট গাড়িটা নিয়ে যাবি।
এটা মন্দ না, মা।
শুভ্ৰ সাদা পাঞ্জাবী পরল। পাঞ্জাবীর হাতা কুঁচকে ছিল। রেহানা নিজে ইস্ত্রি করিয়ে দিলেন। হালকা খয়েরী রঙের প্যান্ট। সাদা পাঞ্জাবী, ধবধবে সাদা স্যান্ডেল। শুভ্রকে রাজপুত্রের মত লাগছে। রেহানা ছেলের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছেন। শাহেদা এবং মতি মিয়া দাতলা উলট-পালট করে ফেলছে। শূভ্রের অস্থির ভাব অনেকটা কেটে গেছে। সে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। একবার শুধু জিজ্ঞেস করল, কটা বাজে মা?
সাড়ে সাতটা বাজে, রেহানা ছেলেকে সেই খবর দিলেন না। বললেন, মাত্র সন্ধ্যা মিলিয়েছে। রাত বেশি হয়নি। তোর বন্ধুর বিয়ে হচ্ছে কোথায়? কম্যুনিটি সেন্টারে?
না। নাখালপাড়ায়। ওরা খুব গরীব। কমু্যনিটি সেন্টার ভাড়া করার মত পয়সা নেই।