আছে কিছু।
সেই কিছুটা কত?
জাহেদ চুপ করে রইল। কেয়া ক্লান্ত গলায় বলল, বিয়ের শাড়ি তো তোমাকে একটা কিনতে হবে। মোটামুটি ভাল একটা শাড়ি কেনা দরকার। আমার মেয়েরা বড় হয়ে মায়ের বিয়ের শাড়ি নিশ্চয়ই দেখতে চাইবে।
ভাল শাড়িই কিনব।
কেয়া বলল, আমার নানি আমাকে কিছু টাকা দিয়েছেন। সামান্যই। চার হাজার টাকা। টাকাটা তুমি নিয়ে যাও।
টাকা লাগবে না।
লাগবে। তোমার কি অবস্থা সেটা আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। ভাল কথা–বিয়ের পর আমি উঠব কোথায়?
এখনো ঠিক করিনি।
একটা কিছু ঠিক করা। তুমি আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে–আমি সেখানেই যাব–শুধু বিয়ের পরেও এখানে ফেলে রেখ না।
তা করব না।
তুমি তো তোমার ছোট মামার সঙ্গেই থাক।
হুঁ।
বারান্দায় ক্যাম্পখাট পেতে ঘুমাও?
হুঁ।
বৃষ্টি হলে ভিজে যাও?
হুঁ।
আমাকেও কি সেই ক্যাম্পখাটে থাকতে হবে?
জাহেদ চুপ করে রইল। কেয়া বলল, ক্যাম্পখাটে থাকতে আমার কোন আপত্তি নেই। এই সব নিয়ে তুমি মন খারাপ করবে না। কষ্ট করে তোমার যেমন অভ্যাস আছে, আমারো আছে। শুধু যদি . . .
শুধু যদি কি?
কেয়া ক্ষীণ স্বরে বলল, শুধু যদি কয়েকটা দিন নিরিবিলি তোমার সঙ্গে থাকতে পারতাম। কেয়া ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি দাঁড়াও এখানে। আমি টাকাটা নিয়ে আসি। তোমাকে এত ক্লান্ত লাগছে কেন? খুব হাঁটাহাটি করছ?
না।
টাকার জন্যে নানা ধরনের লোকজনের কাছে হাত পেতে বেড়াচ্ছ না তো?
না।
কারো কাছে টাকার জন্যে হাত পাতবে না। মনে থাকে যেন। তুমি দাঁড়াও।
পাঁচ মিনিটের ভেতর কেয়া চলে এল। তার হাতে ছোট্ট একটা ট্রে। পিরিচে ঢাকা এক কাপ চা। সঙ্গে দুটা টোস্ট বিসকিট।
ঘরে কিছু নেই। বিসকিট দিয়ে চা খাও।
জাহেদ চা খাচ্ছে। কেয়া তাকিয়ে আছে। কেন জানি তার বড় মায়া লাগছে। তার ইচ্ছে করছে জাহেদকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে। বেশির ভাগ মেয়েরই কি এরকম হয়, না তার বেলাতেই হচ্ছে?
এই খামে টাকা আছে। সাবধানে রাখ। আর শোন, তুমি একটা কাজ করবে–নিজের জন্যে একটা শাট এবং প্যান্ট কিনবে। নীল রঙের। হাফ হাওয়াই শার্ট আর ধবধবে শাদা রঙের প্যান্ট। মনে থাকবে?
নীল শার্ট, শাদা প্যান্ট কেন?
একবার একটা ছেলেকে নীল শার্ট আর শাদা প্যান্ট পরে যেতে দেখেছিলাম। খুব সুন্দর লাগছিল। এখনো চোখে ভাসে।
ছেলেটাকে সুন্দর লাগছিল বলেই আমাকে সুন্দর লাগবে এমন তো কোন কথা নেই।
তর্ক করবে না। যা করতে বলছি করবে।
আচ্ছা, আমি উঠি এখন?
না, বোস আরো খনিকক্ষণ। কোন কথা বলার দরকার নেই। চুপচাপ বসে থাক।
তারা দুজনই চুপচাপ বসে রইল। কেয়ার বোনের ছোট মেয়েটি ছাদে এসে গম্ভীর গলায় বলল, ছোট খালা, মা তোমাকে ডাকে।
কেয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিচে চলে গেল। যাবার সময় জাহেদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েও গেল না।
কেয়াদের বাড়ি থেকে বের হয়ে জাহেদ শুভ্রের বাসায় টেলিফোন করল। রেহানা টেলিফোন ধরলেন এবং বললেন, শুভ্ৰ তো শুয়ে পড়েছে। কি বলতে হবে তুমি আমাকে বল, আমি বলে দেব।
জাহেদ হড়বড় করে বলল, কিছু বলতে হবে না। আমি আপনাদের বাড়ির দারোয়ানের কাছে একটা চিঠি দিয়ে এসেছি।
রেহানা বললেন, শুভ্ৰ চিঠি পেয়েছে।
জাহেদ বাসায় ফিরল রাত এগারোটার দিকে। খেতে গেল রান্নাঘরে। মনোয়ারা ভাত বেড়ে দিলেন। এত রাতে ভাত গরম থাকে না। আজ গরম আছে। গরম গরম ভাত। ডিমভাজা, ডাল। গরম ভাতের রহস্য হল–ভাত রান্না হয়েছে। মনোয়ারার মা। ঢাকায় এসেছেন চিকিৎসার জন্যে। ভাতে টান পড়েছে। নতুন করে রাঁধতে হয়েছে।
মনোয়ারা বললেন, খাওয়ার পর চট করে শুয়ে পড়বে না। তোমার মামা তোমার সঙ্গে কথা বলবেন। জাহেদ বলল, কি কথা মামী?
কি কথা আমি কি করে বলব? আমাকে তো কিছু বলে নাই।
আপনি কিছুই জানেন না?
না, আমি কিছুই জানি না।
মিজান সাহেব কথা খুব কম বলেন। বেশির ভাগ কথাবার্তাই তিনি হ্যাঁ হুঁ-র মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। সেই তুলনায় আজ অনেক কথা বললেন। তাঁর কথার সারমর্ম হচ্ছে–জাহেদ যেন বৌ নিয়ে এ বাসায় না উঠে। তাঁর সামথ্য ছিল না। তারপরেও তিনি দীর্ঘদিন জাহেদকে পুষেছেন। দুজনকে পোষার তীর সামৰ্থ্য নেই। বিয়ে করার মত সাহস যখন জাহেদের আছে তখন নিশ্চয়ই স্ত্রীকে প্রতিপালনের ক্ষমতাও তার আছে। জাহেদ যদি তীর কথা না শুনে বউ নিয়ে এখানে উঠে তাহলে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যাবে।
জাহেদ চুপ করে শুনে গেল। কিছ. বলল না। মিজান সাহেব কিছু শোনার জন্যেও অপেক্ষা করলেন না। এটা তার স্বভাব না। তিনি নিজের কথা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন। নিঃশব্দে সিগারেট শেষ করে ঘুমুতে গেলেন।
আজ সারাদিন জাহেদের খুব পরিশ্রম হয়েছে। বিছানায় শুয়ে পড়ামাত্র ঘুম এসে যাওয়ার কথা কিন্তু ঘুম এল না। সে সারা রাত জেগে কাটাল। শেষ রাতে তন্দ্রার মধ্যে কেয়াকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখল। জলিল সাহেব সেই দুঃস্বপ্নে কেয়াকে বৌ বৌ করে ডাকছেন।
শুভ্র তার চশমা খুঁজে পাচ্ছে না
শুভ্র তার চশমা খুঁজে পাচ্ছে না। বিছানার পাশে রেখে সে বাথরুমে ঢুকেছিল চোখে পানি দিতে। বাথরুম থেকে বের হয়ে সে গেল বারান্দায়। বারান্দায় এ-মাথা থেকে ও—মাথা পর্যন্ত দুবার হাঁটল। ঠিক সন্ধ্যায় চশমা ছাড়া পৃথিবীকে দেখতে তার ভাল লাগে। সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগে। চারদিক অন্ধকার। এই অন্ধকারে বাতি জ্বলে উঠছে। চশমা ছাড়া এই বাতিগুলিকে অনেক উজ্জ্বল এবং ছড়ানো মনে হয়।