জাহেদের ভরসা এখন তার বন্ধু-বান্ধবরা। সে মুখচোরা স্বভাবের। কাউকে এখনো কিছু বলে নি। বলতে লজ্জা করছে। শুভ্রকে গাড়ির কথা বলেছে। গাড়ি পাওয়া যাবে। শুভ্রর কাছে কেউ কিছু চেয়ে পায়নি, তা কখনো হয় নি। গাড়ির ব্যবস্থা হবে। তবে শুভ্রর কানে খবরটা পৌঁছলে হয়। টেলিফোনে শুভ্রকে কখনো পাওয়া যায় না। সে টেলিফোন ধরে না। যে ধরে সে অবধারিতভাবে বলে, শুভ্র বাসায় নেই, কিংবা সে এখন ঘুমুচ্ছে। জাহেদ ঠিক করল, আজ রাত নটা-দশটার দিকে একবার টেলিফোনে চেষ্টা করবে। পাওয়া যাবে না। তবু একবার চেষ্টা করে দেখা। পাওয়া যেতেও তো পারে। নীলিমাদের বাসার কাছেই বড় একটা মিষ্টির দোকান। দোকান নতুন চালু হয়েছে বলেই সেখান থেকে টেলিফোন করতে দেয়। তবে দাকানে ঢুকে এমন ভাব করতে হয় যে প্রচুর মিষ্টি কেনা হবে। কেনার আগে একটু বাড়িতে টেলিফোন করে জেনে নেয়া।
জাহেদের দুলাভাই মোবাশ্বের আলি, জাহেদকে দেখেই মুখ অন্ধকার করে ফেললেন। সব সময়ই করেন। আজ একটু বেশি করলেন। শুকনো গলায় বললেন, তোমার আপা তো নেই। নারায়নগঞ্জ গেছে। আজ আসবে না।
জাহেদ বলল, আপা গয়নাটা এনে রেখেছে কি-না জানেন দুলাভাই?
কোন গয়না?
ঐ যে মার গলার একটা হার। পালিশ করতে দিয়েছিল।
ও আচ্ছা–হাঁ–একটা ঝামেলা হয়ে গেছে, বুঝলে? বিরাট ঝামেলা।
জাহেদ হতভম্বর গলায় বলল, কি ঝামেলা?
দোকানই উঠে গেছে। হিন্দু দোকান ছিল, মনে হয় কাউকে কিছু না জানিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। ইন্ডিয়া যাওয়ার একটা ধুম পড়েছে। তবু খোঁজ খবরের চেষ্টা করা হচ্ছে–কিছু হবে বলে মনে হয় না। ঐটার আশা তুমি ছেড়ে দাও।
জাহেদ করুণ গলায় বলল, কি বলছেন দুলাভাই!
যা সত্য তাই বললাম। তবে তোমার বৌকে গয়না। আমরা একটা দিব। এখন পারব না। ধীরে সুস্থে দিব। তোমার আপা পরশুদিন আসবে। তখন এসে খোঁজ নিও। সে বিস্তারিত বলবে।
বিস্তারিত কি বলবো?
কোন দোকানে জমা দিয়েছিল, কি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই সব আরকি। জানা না জানা অবশ্যি সমান।
জাহেদ উঠে দাঁড়াল। মোবাশ্বের আলি বললেন, চলে যাচ্ছ?
জ্বি।
আচ্ছা যাও। চা খেতে চাইলে খেতে পার। কাজের মেয়েটাকে বললে চা বানিয়ে দেবে।
না, চা খাব না।?
জাহেদ ঘর থেকে বের হয়ে এল। ভেবে পেল না, একবার কেয়ার কাছে যাবে কি-না। এত সকাল সকাল শুভ্ৰকে টেলিফোন করা ঠিক হবে না। রাত নটার পর করতে হবে। নটা পর্যন্ত কি করবে? বরং কেয়ার সঙ্গে দেখা করে আসা যাক।
কেয়াদের বাসায় যেতে লজ্জা করে। অস্বস্তিও লাগে। কেয়ার বড় বোন তাকে সহ্যই করতে পারে না। অবশ্যি এই মহিলা হয়ত কোন কিছুই সহ্য করতে পারে না। আজ পর্যন্ত জাহেদ তাকে মিষ্টি করে কথা বলতে শুনেনি। জাহেদের ইচ্ছা সময় এবং সুযোগ হলে সে ভদ্রমহিলাকে বলবে–বকুল আপা, ফুলের নামে আপনার নাম কিন্তু সবার সঙ্গে এমন কঠিন আচরণ করেন কেন? সেই সুযোগ হয়ত কখনোই হবে না।
জাহেদ কেয়াদের পাঁচতলার ফ্ল্যাটে উপস্থিত হল রাত নটায়। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় উঠতে হয়। পাঁচতলা পর্যন্ত ঘন অন্ধকার। এই অন্ধকারে সিঁড়ি ভাঙ্গা খুবই ক্লান্তিকর ব্যাপার। সব সময় মনে হয় এই বুঝি সিঁড়ি শেষ হল, কিন্তু শেষ হয় না। এক সময় মনে হয় সিঁড়ির ধাপগুলির উচ্চতার হের-ফের ঘটছে। এক ধরনের টেনশান, সিঁড়িতে ঠিকমত পা পড়ছে তো?
বেল টিপতেই জলিল সাহেব দরজা খুলে দিয়ে হাসিমুখে বললেন, আরে আসুন, আসুন। মনে মনে আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। কেয়া ঘরেই আছে। বাচ্চাদের পড়াচ্ছে। বসুন, ডেকে দিচ্ছি।
জলিল সাহেবর পরনে লুঙ্গি এবং গেঞ্জি। তিনি সেইভাবেই ভেতরে ঢুকে গেলেন। তিনি এ পরিবারের কেউ না। এদের একটি কামরা সাবলেট নিয়েছেন। মাসে সাতশ করে ঢাকা দেন। সাতশ টাকা কেয়া দেয়। সংসারে খুব কাজে লাগে। জলিল সাহেবকে পরিবারের একজন বলেই মনে হয়। ব্যাপারটা জাহেদের ভাল লাগে না। একজন বাইরের লোক কেন এমনভাবে ঘুরঘুর করবে? কেন সে কেয়াকে বলবে–কেয়া, দেখ তো আমার লুঙ্গি শুকিয়েছে কি-না। না শুকালে উল্টে দাও।
কেয়ার মুখ শুকনো।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কোন কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত। সে ঘরে ঢুকেই বলল, কিছু বলবে?
জাহেদ বলল, না। তোমার কি শরীর খারাপ?
কেয়া বলল, শরীর ঠিকই আছে। এসো আমার সঙ্গে–ছাদে যাই। ছাদে গিয়ে কথা বলি।
কেয়া দরজার দিকে যাচ্ছে। পেছনে পেছনে যাচ্ছে জাহেদ। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না কেয়ার মন এত খারাপ কেন?
উঁচু দালানের ছাদ ভাল লাগে না। সব সময় এক ধরনের অস্বস্তি লেগে থাকে। মনে হয়। পৃথিবী থেকে অনেক দূরে ছাদে উঠবার মুখে সিঁড়িটা ভাঙা। কেয়া বলল, আমার হাত ধর। সিঁড়ি ভাঙা।
জাহেদ হাত ধরল। কত সহজ, কত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে এই মেয়েটির হাত ধরতে পারছে! এই আনন্দের কি কোন তুলনা হয়।
কেয়া রেলিং ঘেঁসে দাঁড়িয়েছে। জাহেদ বলল–এমন ঘেঁসে দাড়িও না। রেলিং ভেঙে পড়ে যেতে পারে। আজকাল দালান-কোঠা বানাতে সিমেন্ট দেয় না। বালি দিয়ে কাজ সারে। তুমি এত চুপচাপ কেন কেয়া? কিছু হয়েছে?
না, কি হবে। বিয়ের জোগাড়-যন্ত্র কি সব হয়েছে?
কিছুটা। বরযাত্রীর জন্যে মাইক্রোবাস ব্যবস্থা করেছি।
কি এক বিয়ে, তার আবার বরযাত্রী।
জাহেদ বলল, যত তুচ্ছ বিয়েই হাক, বিয়ে তো।
কেয়া বলল, টাকা-পয়সা আছে তোমার কাছে?