জাহেদ দারোয়ানকে বলল, ঘণ্টা দু-এক পর এসে খোঁজ নেই, কি বলেন?
নিতে পারেন।
দারোয়ান গোট বন্ধ করে ভেতর থেকে তালাবন্ধ করে দিল। এ বাড়ির গেট সব সময় ভেতর থেকে তালাবন্ধ থাকে।
জাহেদ এক কাপ চা, দুটা টোস্ট বিসকিট খেল। লোভে পড়ে একটা কলাও খেয়ে ফেলল। আজ সকালে নাশতা খেতে পারেন। দারুণ খিদে লেগেছে। অপরিচিত চায়ের দোকানে বসে সময় কাটানোও সমস্যা। কিছুক্ষণ বসে থাকলেই দোকানের মলিক সন্দেহজনক চোখে তাকাতে শুরু করে। সময় খারাপ, সব কিছুই দেখতে হয় সন্দেহের চোখে। তারচেয়েও বড় সমস্যা জাহেদের কাছে ঘড়ি নেই–দুঘণ্টার কতক্ষণ কাটল বোঝা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পর একে ওকে কটা বাজে জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে। একটা সময় ছিল কটা বাজে। জিজ্ঞেস করলে লোকজন খুশি হত। আগ্রহ করে সময় বলত। এখন রেগে যায়। এমনভাবে তাকায় যেন সময় জানতে চাওয়ার পেছনেও কোন মতলব আছে।
জাহেদ দেড় ঘণ্টার মাথায় আবার বেল টিপল। দারোয়ান নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, আসেন নাই। কিছু বলার থাকলে আমারে বলেন–খবর দিয়া দিব।
জাহেদ বলল, ভায়া মিডিয়া বললে হবে না। সরাসরি বলতে হবে। বরং একটা চিঠি লিখে যাই।
লেখেন।
কাগজ-কলম দিতে পারবেন?
না।
জাহেদকে আবার সেই চায়ের দোকানে ফিরে যেতে হল। দোকানের মালিকের কাছ থেকে কাগজ-কলম নিয়ে সে লিখল —
শুভ্ৰ, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বুধবারে। তুই কি বরযাত্রী যাবার জন্য আমাকে একটা গাড়ি দিতে পারবি?—
দারোয়ানের কাছে চিঠি জমা দিয়ে সে কলাবাগান রওনা হল হাঁটতে হাঁটতে। হাঁটতে খারাপ লাগছে না, কিন্তু খিদেটা জানান দিচ্ছে। পেটে অল্প-অল্প ব্যথাও শুরু হয়েছে। ব্যাথাটাকে আমল দেয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া তুচ্ছ শারীরিক সমস্যা নিয়ে চিন্তার সময় নেই। মাথার সামনে ভয়াবহ সমস্যা। প্রথম এবং প্রধান সমস্যা হল–কেয়াকে কোথায় এনে তুলবে? সে নিজে থাকে ছোটমামার বাসায়। ভেতরের বারান্দায় ক্যাম্পখাট পেতে ঘুমায়। বৃষ্টির সময় অবধারিতভাবে ক্যাম্পখাটের খানিকটা বৃষ্টির পানিতে ভিজে। বউকে নিয়ে ক্যাম্পখাটে ঘুমানো সম্ভব না। ছোটমামার বাড়িতে দুটা কামরা। একটায় ছোট মামা-মামী থাকেন। অন্যটায় মামার তিন মেয়ে থাকে। বসার ঘর বলে কিছু নেই। থাকলে কোন সমস্যা ছিল না। কয়েকটা দিন সোফায় পার করে দেয়া যেত। কেয়া ঘুমাতো সোফায়, সে মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে।
জাহেদ তার মামা মিজান সাহেবকে বিয়ের খবর দিয়েছে। পরশু। রাতের ভাত খাবার পর। জাহেদ ভয়ে ভয়ে ছিল–খবর শুনে মামা না জানি কি করেন। তেমন কিছুই করেননি। তিনি দীর্ঘসময় জাহেদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছেন–ও। তিনি হতভম্ভ হয়ে গেছেন, বিলাই বাহুল্য। এই অবস্থায় জাহেদ বিয়ে করতে যাচ্ছে কেন? বউকে খাওয়াবে কি? বউ থাকবে কোথায়?–কিছুই জানতে চান নি। জাহেদের মামী মনোয়ারা বললেন, সত্যি বিয়ে, না ঠাট্টা করছি?
জাহেদ বলল, সত্যি সত্যি বিয়ে করছি, মামী। মেয়ের নাম কেয়া। এ বাড়িতে দুবার এসেছে। আপনি হয়ত দেখেছেন। কেয়ার নানি মৃত্যুশয্যায়। তিনি নাতনীর বিয়ে দেখে যেতে চাচ্ছেন আর কেয়ার আপা—দুলাভাইও কেয়াকে আর পুষতে পারবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
ওরা কি দেখে তোমার কাছে বিয়ে দিচ্ছে–তোমার আছে কি?
জাহেদ কিছু বলল না। মনোয়ারা বললেন–বউ নিয়ে কোথায় উঠবে?
জাহেদ বলল, এখনো কিছু ঠিক করিনি।
তোমার কি কোথাও ওঠার জায়গা আছে?
জ্বি না।
বিয়ের খরচপাতির টাকা-পয়সা আছে?
জাহেদ মাথা চুলকে বলল, জ্বি না।
মিজান সাহেব ঠিক আগের ভঙ্গিতে বললেন, ও!
জাহেদের এই মুহুর্তে কিছুই নেই। পোস্টাফিসে পাসবই খুলেছিল। টিউশনির টাকার কিছু কিছু সেখানে রাখত। পাসবইয়ে সাতশ তেত্রিশ টাকা আছে। মার গলার একটা হার আছে দেড় ভরীর। ওটা বিক্রি করলে বিয়ের খুচরা খরচ সামলে ফেলা যায়। বিয়ের খরচ বলতে বিয়ের শাড়ি, হলুদের শাড়ি। কিছু সেন্ট-ফেন্ট। কিন্তু মা বিশেষ করে বলে দিয়েছেন হারটা যেন জাহেদের বিয়ের সময় তার বৌকে দেয়া হয়। এইসব সেন্টিমেন্ট নিয়ে ভাবলে এখন চলে না। সেন্টিমেন্টের দিন শেষ। আজকের দিন হল রিয়েলিটির দিন। হার বর্তমানে তার বড় বোন নীলিমার কাছে আছে। সেই হার পাওয়া যাবে কি-না তা নিয়ে জাহেদের ঘোর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। দিন সাতেক আগে আনতে গিয়েছিল। নীলিমা বলল, হার পালিশ করতে দেয়া হয়েছে। গতকাল জাহেদ আবার গেল। নীলিমা বলল, রশিদটা পাওয়া যাচ্ছে না। বলেই এক ধরনের ঝগড়া শুরু করল। ঝগড়ার বিষয় হল–তার বিয়ের সময় মা কিছুই দেন নি। হাতের দুটা বালা দিয়েছে। তার মধ্যে সোনা নামমাত্র। জাহেদ বলল, এসব আমাকে বলে লাভ কি? আমি এর কি করব?
নীলিমা বলল, হাতের বালা জোড়া মার ব্যবহারী জিনিস হলেও একটা কথা ছিল। আমি কিছুই বলতাম না। স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রেখে দিতাম। দাকানের জিনিস। কোন এক কায়দা করে নীলিমা গলার হারটা রেখে দিলে জাহেদ বিরাট বিপদে পড়বে। এতটা নিচে আপ নামবে জাহেদ বিশ্বাস করে না। কিন্তু অবিশ্বাস্য জিনিস সংসারে ঘটছে। তাছাড়া অভাবী সংসারে ক্ষুদ্রতা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
জাহেদ বিয়ে করছে। কেউ কোন রকম আগ্রহ দেখাচ্ছে না। নীলিমা একবারও জিজ্ঞেস করেনি, বৌ নিয়ে কোথায় উঠবি? সম্ভবত ভয়েই জিজ্ঞেস করেনি, যদি জাহেদ বলে বসে। কয়েকটা দিন তোমার এখানে থাকব। সে হয়ত ভেবেছে, একবার বৌ নিয়ে উঠলে আর তাকে তাড়ানো যাবে না। এরকম ভাবা অবশ্যি অন্যায়ও না। ভাবাটাই স্বাভাবিক।