তুমি কি বলতে চাচ্ছি। তোমার মা চান বলেই তুমি হ্যাঁ বললে? তোমার নিজের ইচ্ছা নেই?
আমার নিজের ইচ্ছাও নেই, অনিচ্ছাও নেই।
তোমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ কি বিয়ে করেছে?
এখনো করেনি। তবে জাহেদ সম্ভবত করবে।
জাহেদ কে?
আমার বন্ধু। আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আমি দেখেছি তাকে?
না। আমার বন্ধুরা কখনো আমার কাছে আসে না। আমি তাদের কাছে যাই।
ও কি করে?
এখনো কিছু করে না। প্রাইভেট টিওশনি করে।
তোমার কি মনে হয় না জাহেদ খুব দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত কাজ করছে?
এর উপায় নেই, বাবা।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করেন, উপায় নেই কেন? শেষে নিজেকে সামলে নিলেন। বাড়তি কৌতূহল দেখানোর প্রয়োজন তিনি বোধ করছেন না। কিন্তু তিনি প্রয়াজন বোধ না করলেও শুভ্র করছে। সে খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, জাহেদ আসলে দারুণ সমস্যায় পড়েছে। ও যাকে বিয়ে করবে তার নাম কেয়া। বড় বোনের বাসায় থাকে। বড় বোন এবং দুলাভাই দুজনই বেচারীকে নানাভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছে। দুবার প্রায় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। একবার কেয়া রাত আটটার সময় বাড়ি ফিরেছে। তারা দরজা খুলে না। দরজা বন্ধ। বেচাবী রাতএগারোটা পর্যন্ত বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদল।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, কেয়ার সঙ্গেও কি তোমার পরিচয় আছে?
হ্যাঁ, পরিচয় আছে। খুব ভাল মেয়ে। গম্ভীর হয়ে থাকে, কিন্তু মাঝে মাঝে এমন হাসির কথা বলে!
প্রাইভেট টিউশনি সম্বল করে একটা ছেলে বিয়ে করে ফেলতে চাচ্ছে–তোমার কাছে কি হাস্যকর মনে হচ্ছে না?
জহিরের কোন উপায় নেই, বাবা। ওকে প্রাইভেট টিউশনি করে খেতে হবে।
প্রাইভেট টিউশনি করে খেতে হবে কেন?
ও বি.এ. পরীক্ষায় থার্ড ডিভিশন পেয়েছে–ওর পরিচিত বড় আত্মীয়স্বজনও নেই। ওর ধারণা, ও কখনো কোন চাকুরি পাবে না।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব গোপনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন, তার ছেলে কাদের সঙ্গে মিশছে? এরাই কি তার বন্ধুবান্ধব? রেহানা একটু ঝুঁকে এসে আগ্রহ নিয়ে বললেন, শুভ্ৰ, তুই কি জাভেদ সাহেবের ভগ্নির সঙ্গে কথা বলে দেখবি? মেয়েটার নাম শাপলা। টিভিতে নাটক করে। খুব সুন্দর।
শুভ্ৰ হাসতে হাসতে বলল, তোমার মাথায় শুধু একটা জিনিসই ঘুরছে। শোন মা, তুমি যদি চাও নিশ্চয়ই আলাপ করে দেখব।
ওকে সঙ্গে করে কোন একটা রেস্টুরেন্টে খেয়ে এলি। গল্প-টল্প করলি। ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই ওকে তোর পছন্দ হবে। কথা বলবি?
কেন বলব না মা?
ইয়াজউদ্দিন সাহেবের রেহানার কথাবার্তা পছন্দ হচ্ছে না। তিনি কিছু সিরিয়াস কথাবার্তা বলতে চাচ্ছিলেন। রেহানার উপস্থিতিতে তা সম্ভব হবে না। তিনি বললেন, ঘুম পাচ্ছে, চল ঘুমুতে যাওয়া যাক। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। রেহানা উঠলেন না। ছেলের পাশে বসে রইলেন। আগ্রহ ও উত্তেজনায় তার চোখ চকচক করছে।
কান্তা ভিলা
শুভ্রদের বাড়ির নাম কান্তা ভিলা।
গেটের কাছে পেতলের নামফলক। রোজ একবার ব্ৰাস ঘসে এই নাম ঝকঝকে করা হয়। গুলশান এলাকার আধুনিক বাড়িঘরগুলির সঙ্গে এর মিল নেই–পুরানো ধরনের বাড়ি। জেলখানা—জেলখানা ভাব আছে। উঁচু দেয়াল। দেয়ালের উপরে কাঁটাতারের বেড়া। বাড়ির গেটটাও নিরেট লোহার। বাইরে থেকে গেটের ভেতর দিয়ে কিছু দেখার উপায় নেই। গেটের কাছে কলিংবেল আছে। অনেকক্ষণ বেল বাজালে তবেই দারোয়ান দরজা খুলে বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করে, কে? কারণ এ বাড়িতে যারা আসে তারা গেটের কলিংবেল বাজায় না। গাড়ির হর্ন বাজায়। এ বাড়িতে যেসব গাড়ি আসে তার প্রতিটির হর্ন দারোয়ান চেনে। হর্ন শুনে বুঝতে পারে কে এসেছে। গাড়ির হর্ন শুনলে সে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে। গেটের কলিংবেল বাজায় খবরের কাগজের হকার, ধাপা, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, মাঝে মাঝে অসীম সাহসী কিছু ভিখিরী। এদের বেল শুনে ছুটে গিয়ে গেট খালার কোন প্রয়াজন নেই। ধীরে সুস্থে গেলেই হয়।
অনেকক্ষণ ধরেই বেল বাজছে। দারোয়ান গোমেজ গেট খুলছে না। সে মোড়ায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে। বেল বাজছে, বাজুক। ভিখিরী হলে বেল বজিয়ে ক্লান্ত হয়ে চলে যাবে। ভিখিরী না হলে ক্লান্ত হবে না। বাজাতেই থাকবে। এক সময় গেট খুললেই হল। তাড়া কিছু নেই।
গোমেজ হাত থেকে খবরের কাগজ নামিয়ে রাখল। বিরক্ত মুখে উঠে গিয়ে দরজা খুলল। গেটের বাইরে জাহেদ দাঁড়িয়ে আছে। গোমেজ জাহেদকে চেনে–শুভ্রর বন্ধু। এর আগেও কয়েকবার এসেছে, তবে কখনো গেটের ভেতরে ঢুকেনি।
জাহেদ বলল, শুভ্ৰ আছে?
গোমেজ হাই তুলতে তুলতে বলল, না।
এটা পরিষ্কার মিথ্যা কথা। শুভ্র ঘরেই আছে। গোমেজ কেন না বলল সে নিজেও জানে না। তাকে কেউ মিথ্য বলতে বলেনি। জাহেদ বলল, ওর সঙ্গে খুব দরকার ছিল। ও কোথায় গেছে জানেন?
না।
কখন বাসায় ফিরবে সেটা বলতে পারবেন?
উঁহু।
জাহিরের মন খারাপ হয়ে গেল। আজ বাসের স্ট্রাইক। সে কলাবাগান থেকে গুলশান পর্যন্ত এসেছে অনেক যন্ত্রণা করে। কিছু হেঁটে, কিছু শেয়ারের রিকশায়, কিছুটা টেম্পোতে। সুযোগ বুঝে টেম্পোর ভাড়া করে দিয়েছে দুগুণ। তার পকেটে এখন সাতটা টাকা আছে। এই সাত টাকায় কলাবাগান ফিরে যাওয়াই সমস্যা। তা ছাড়া প্ৰচণ্ড চায়ের পিপাসা পেয়েছে। এক কাপ চা এবং একটা বিসকিট না খেলেই নয়। পেটের আলসার খুব খারাপ পর্যায়ে আছে। ডাক্তার খালি পেটে চা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। চা-বিসকিট খেতে গেলে তিনটাকা চলে যাবে। থাকবে মাত্র চার।