আমি দেখব কেন?
তোমার পছন্দ হলে শুভ্রর জন্যে আমি মেয়ের মামা জাভেদ সাহেবের কাছে প্ৰস্তাব দিতাম।
বিয়ে করবে শুভ্ৰ। আমার পছন্দের ব্যাপার আসছে কেন?
শুভ্রের কোন পছন্দ-অপছন্দ নেই, মতামত নেই। ওকে বিয়ের কথা বললেই হাসে…
ইয়াজউদ্দিন জড়ানো গলায় বললেন, এখন ঘুমাও। ভোরবেলা কথা বলব। ইয়াজউদ্দিন পাশ ফিরে শূলেন। কোনভাবে শুয়েই তিনি আরাম পাচ্ছেন না। বারান্দায় চটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শুভ্ৰ হাঁটছে। বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথায় যাচ্ছে।
রেহানা।
হুঁ।
শুভ্ৰ কি বারান্দায় হাঁটাহাটি করছে?
কই, না তো!
মনে হচ্ছে চটির শব্দ শুনলাম।
ভুল শুনেছ। শুভ্ৰ চটি পরে না।
ও আচ্ছা।
ইয়াজউদ্দিন চিৎ হয়ে শূলেন। তাঁর মস্তিক নিশ্চয়ই উত্তেজিত। উত্তেজিত মস্তিকে চটির শব্দ শুনছেন। তাঁর শরীর তাহলে ভালই খারাপ হয়েছে। এমন কি হতে পারে যে তিনি ঘুমের মধ্যে মারা যাবেন! ঘুমিয়ে মৃত্যুর ব্যাপারটা প্রায় কখনো হয় না বললেই হয়–প্রকৃতি মানুষকে জাগ্রত অবস্থায় পৃথিবীতে নিয়ে আসে, নিয়েও যায় জাগ্রত অবস্থায়। তাঁর বেলায় নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম ঘটবে না। তবু ভয় লাগছে।
রেহানা!
কি।
পানি খাব।
রেহানা উঠলেন। পানির জন্যে একতলায় যেতে হল। দোতলায় ছোট একটা ফুীজ আছে। সেখানে পানির বোতল রাখা হয়নি। ইয়াজউদ্দিন বরফ-শীতল পানি ছাড়া খেতে পারেন না। রেহানা পানির বোতল এবং গ্লাস নিয়ে দোতলায় উঠে এসে দেখেন, ইয়াজউদ্দিন খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। তার মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। শোবার সময় পাতলা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে শুয়েছিলেন। পাঞ্জাবী খুলে ফেলেছেন। তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
তিনি এক চুমুকে পানির গ্লাস খালি করলেন। ঘড়ি দেখলেন, তিনটা বাজতে চলল, রাত শেষ হবার খুব বেশি দেরি নেই।
শুভ্র কি জেগে আছে?
মনে হয়। ঘরে বাতি জ্বলছে।
ওকে একটু ডাক তো।
এখানে আসতে বলব?
না। বারান্দায় এসে বসতে বল।
তুমি ঘুমুবে না?
আজ আর ঘুমুব না। ঘুম আসছে না।
চা খাবে? চা করে দেব?
দাও।
রেহানা চা আনতে গেলেন। ইয়াজউদ্দিন বারান্দায় এসে বসলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুভ্রও এসে বাবার পাশে বসল। শুভ্রর হাতে একটা বই। অন্ধকারে বইয়ের নাম পড়া যাচ্ছে না। বেশ মোটা বই।
শুভ্র বলল, জেগে আছ কেন, বাবা? এই সময় তো তোমার জেগে থাকার কথা না। সমস্যাটা কি?
শরীর ভাল লাগছে না। ঘুমুতে চেষ্টা করছি, ঘুম আসছে না।
তোমাকে খুব চিন্তিত লাগছে। তুমি কি কোন কিছ নিয়ে চিন্তিত?
না।
আজ পত্রিকায় দেখলাম, তোমার কটন মিলে গণ্ডগোল হয়েছে। মিলের ম্যানেজারের পায়ের রাগ কেটে দিয়েছে। তুমি কি এ ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত?
আমি যখন ঘরে আসি তখন আমার বাইরের কর্মজগৎ ঘরে নিয়ে আসি না। মিলের ব্যাপারটা নিয়ে আমি চিন্তিত ঠিকই, কিন্তু আজকের শরীর খারাপের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। তুমি জেগে আছ কেন বল।
আমি তো প্রায়ই রাত জাগি।
এমনভাবে কথাগুলি বললে যেন রাত জাগা খুব মজার ব্যাপার।
শুভ্ৰ হালকা গলায় বলল, আমার কাছে ভালই লাগে।
রাত জেগে তুমি কি কর?
কিছুই করি না। মাঝে মধ্যে পড়াশোনা করি। তবে বেশির ভাগ সময় চুপচাপ বসে থাকি। ভাবি।
কি ভাব?
শুভ্ৰ জবাব দিল না। হাসল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব আগ্রহ নিয়ে ছেলের হাসি দেখলেন। শুভ্রর হাসি সুন্দর। দেখতে ভাল লাগে। সব শিশুর হাসি সুন্দর। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাসির সৌন্দর্য নষ্ট হতে থাকে। শুভ্রর হয়নি।
রেহানা চা নিয়ে এসেছে। চা আনতে তাঁর দেরি হবার কারণ বোঝা যাচ্ছে–শুধু চা আসে নি। আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে সকালের ব্রেকফাস্ট চলে এসেছে। শুভ্র ওঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি একটু আগে চা খেয়েছি। আমি কিছু খাব না। তোমরা খাও।
ইয়াজউদ্দিন বললেন, তুমি বাস শুভ্ৰ। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।]
শুভ্র বসল। রেহানা বললেন, আমি কি বসব, না চলে যাব?
বস, তুমিও বস।
ইয়াজউদ্দিন চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, কি বই পড়ছ?
শুভ্র বলল–The End of Civilization.
ইন্টারেস্টিং বই?
না বাবা। কঠিন বই। নানান থিওরি। পড়তে ভাল লাগে না।
পড়তে ভাল লাগে না–তাহলে পড়ছ কেন?
যা আমার ভাল লাগে না তাও করে দেখতে ইচ্ছে করে।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। আবহাওয়াটা চট করে অন্য রকম হয়ে গেছে। এখন মনে হচ্ছে তিনি কোন একটা মিটিং-এ বসেছেন। কোম্পানীর জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ করছেন শুভ্রের সঙ্গে। রেহানা তাঁর পিএ, সে নোট নিচ্ছে। এক্ষুণি পিপ করে ইন্টারকম বেজে ওঠবে। রেহানা বলবে, স্যার, আপনার জরুরি কলা। আপনি কথা বলবেন? লাইন দেব?
বাস্তবে তা হল না। রেহানা খুশি-খুশি গলায় বললেন, তুমি শুভ্রকে জিজ্ঞেস কর তো ও বিয়ে করতে চায় কি-না। শুভ্ৰ হাসিমুখে মার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন মার ছেলেমানুষিতে মজা পাচ্ছে।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, তোমার মা তোমার বিয়ে নিয়ে খুব একসাইটেড বোধ করছে। তুমি কি বিয়ে করতে চাও?
শুভ্র বাবার চোখের উপর থেকে চোখ সরিয়ে মার দিকে তাকাল। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পরিস্কার গলায় বলল, হ্যাঁ চাই।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কোন ছেলেকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়–সে বিয়ে করতে চায় কি-না তখন সে কিন্তু কখনো সরাসরি বলে না–চাই। তুমি এত সরাসরি বললে কেন শুভ্র?
শুভ্ৰ হাসতে হাসতে বলল, আমি মাকে খুশি করবার জন্যে বললাম। মা মনেপ্ৰাণে এইটিই আমার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছিল।