শুভ্র বলল, আপা আমি এক গ্লাস পানি খাব।
পানি এনে দিচ্ছি। কিন্তু খবর্দার। আপা ডাকবে না। যাকে বিয়ে করতে চাও তাকে আপা ডাকতে অস্বস্তি লাগছে না?
নীতু পানি এনে দিল। শুভ্ৰ পানি শেষ করল। নীতু বলল, আমার কথা বোধহয় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কেন জান? কাল রাতে ঘুম হয়নি। সারারাত ছটফট করেছি। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তেবে কি হয়েছে? একবার ভাবলাম বলি, শুভ্র আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে এই উত্তেজনায় আমার ঘুম হচ্ছে না। শেষে বললাম না। বাবাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করল না। আমি কি করলাম জান শুভ্র? সারারাত বারান্দায় হাঁটাহাটি করুলাম। দুবার মাথায় পানি ঢাললাম। তারপর ঠিক করলাম, তুমি যখন আসবে তখন তোমাকে বলব আমার শরীরটাই তো তোমার দরকার। বেশতো শরীরটা কিছুক্ষণের জন্যে তোমাকে দেব। তার বদলে মোটা অংকের কিছু টাকা তুমি আমাকে দাও। টাকাটা পেলে আমার লাভ হবে। বাবাকে দিয়ে দিতে পারব। তিনি শান্ত হবেন। ঘর ভাড়া করে একা একা থাকবেন। তাঁর সেবার জন্যে কিছু লোকজন থাকবে। আমার বুদ্ধিটা ভাল না। শুভ্ৰ?
শুভ্ৰ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নীতু বলল, কথা বলছ না কেন? তুমি চাইলে আমি সব কাপড় খুলে ফেলতে পারি। ঘরেও কেউ নেই। তবু তোমার কাছে যদি মনে হয়। ঘরে বেশি আলো তাহলে জানালা বন্ধ করে দিতে পারি।
শুভ্র কিছু বলার আগেই নীতু উঠে জানালা বন্ধ করে দিল। ঘর আবছা অন্ধকার হল। নীতু বলল, অন্যদিকে তাকাও শুভ্ৰ। নগ্ন হয়ে প্রেমিকের সামনে আসা কঠিন নয়। কিন্তু প্রেমিকের সামনে নগ্ন হওয়া বেশ কঠিন।
শুভ্ৰ বলল, আপা কেন আপনি আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন? আমি আপনাকে আর বিরক্ত করব না। চলে যাব। আমি কিন্তু আপা কখনোই আপনাকে অপমান করতে চাই নি। তবু আপনি আমার কথায় অপমানিত হয়েছেন। I am sorry.
নীতু লক্ষ্য করল শুভ্ৰ কাঁদছে। ছোট শিশুদের মতই কাঁদছে। নীতু কোমল গলায় বলল, তুমি সবেরের বন্ধু। তোমাকে আমি তার মতই দেখি। এবং পাগলের মত পছন্দ করি। কেঁদো না শুভ্ৰ–তুমি কাছে আসি আমি তোমাকে আদর করে দি। সাবের যখন খুব মন খারাপ করতো সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো। আমি তাকে মাথায় হাত দিয়ে আদর করতাম।
শুভ্ৰ উঠে দাঁড়াল। শান্ত গলায় বলল, নীতু আপা আমি যাই। আপনি চাচাকে নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। আমার এখন অনেক ক্ষমতা নীতু আপা। আমি এখন অনেক কিছু করতে পারি।
নীতু কোমল গলায় বলল, আমি জানি। তোমার বাবা আমার কাছে এসেছিলেন। সব দায়িত্ব তোমার কাছে দিয়ে তিনি বিশ্রাম নিতে যাচ্ছেন সেই কথা আমাকে বলেছেন।
আর কি বলেছেন?
নীতু হাসতে হাসতে বলল, আরেকটা অন্যায় অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন আমি যেন তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হই। প্রত্যাখ্যানের অপমান থেকে তিনি তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা হয় না শুভ্ৰ। তুমি কি বুঝতে পারছি যে তা হয় না?
পারছি।
তোমার বাবাকে আমার রিগার্ডস দিও। চমৎকার মানুষ। আমার উনাকে পছন্দ হয়েছে। বুঝলে শুভ্র উনি যুক্তি দিয়ে আমাকে প্রায় বুঝিয়ে ফেলেছিলেন যে তোমাকেই আমার বিয়ে করা উচিত।
বাবা খুব ভাল যুক্তি দিতে পারেন।
আমার উনাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমি কাউকেই পা ছুয়ে সালাম করি না। আমার ভাল লাগে না। কিন্তু তঁকে পা ছুয়ে সালাম করেছি।
সেই প্রিয় মুখ নেই
ইয়াজউদ্দিন সাহেবের মেসিভ হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। রেহানা স্বামীর হাত ধরে বসে আছেন। তিনি থরথর করে কাঁপছেন। এ্যাম্বুলেন্স খবর দেয়া হয়েছে–এখনো আসছে না। শুভ্র বাড়িতে নেই। রেহানা অস্থির হয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে তিনি অচেতন হয়ে পড়বেন। ইয়াজউদ্দিন সাহেব স্ত্রীর অস্থিরতা দেখে হাসলেন। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, শুভ্রর সঙ্গে দেখা হবে কি-না। আমি বুঝতে পারছি না। যদি দেখা না হয়, যদি এই যাত্রাই আমার শেষ যাত্রা হয়, তাহলে তুমি শুভ্রকে বলবে অন্যদশজন বাবা তার ছেলেকে যতটা ভালবাসে আমি তাকে তারচে অনেক বেশি ভালবাসি। তার মত একটি ছেলের জন্ম আমি দিতে পেরেছি। এই আনন্দই আমার জন্যে যথেষ্ট। আমি বিপুল অর্থ ও বিত্ত শুভ্রর জন্যে রেখে গেলাম–আমার দেখার খুব শখ শুভ্র এই অর্থ বিত্ত দিয়ে কি করে। আমার এই শখ বোধ হয় মিটবে না মনে হচ্ছে। এ আমার শেষ যাত্রা।
মৃত্যুর আগে কিছুক্ষণের জন্যে ইয়াজউদ্দিন সাহেবের জ্ঞান ফিরল, তিনি এদিক ওদিক তাকালেন–হয়ত শুভ্রকে খুঁজলেন। তাঁর খুব ইচ্ছা শুভ্রকে একটু ছুঁয়ে দেখেন। তিনি ফিস ফিস করে ডাকলেন শুভ্ৰ! শুভ্ৰ!
তাঁর চারপাশে একদল মুখোশ পরা ডাক্তার। কয়েকজন নার্স। সেই প্রিয় মুখ নেই।