মনোয়ারা মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে গেলেন। মিজান সাহেবের মেয়ে দুটি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন–খুকীরা, ভয়ের কিছু নেই। নিৰ্ভয়ে থাক।
জাহেদ পাড়ার ডাক্তার সাহেবকে ডেকে আনন। তিনি ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। জাহেদকে বললেন, রুগীর অবস্থা ভাল দেখছি না। যে কোন সময় ভায়োলেন্ট পর্যায়ে চলে যেতে পারে। আপনি বরং কোন একটা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দেন। বাচ্চা কাচ্চার সংসার। একটা দুৰ্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ? ইনজেকশনের এফেক্ট বিকেল পর্যন্ত থাকবে। এরমধ্যে একটা ব্যবস্থা করে ফেলুন। বনানীতে একটি ক্লিনিক আছে–নাম হল মেন্টাল হাম। ইলেকট্রিক শক দেবার ব্যবস্থা আছে। ঠিকানা আছে আমার কাছে–চার্জ বেশি। কিন্তু টাকার দিকে তাকালেতো এখন হবে না। দেব ঠিকানা?
জাহেদ বলল, দিন।
আপনাদের বংশে পাগলের হিস্ট্রি আছে?
জ্বি না।
আজকাল অবশ্যি হিস্ট্রি ফিস্ট্রি লাগে না। এমিতেই লোকজন পাগল হয়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিলে দেখবেন ডিসপেনসারিগুলিতে নাৰ্ভ ঠাণ্ডা রাখার অষুধ সবচে বেশি বিক্রি হয়। ঘুমের অষুধ ছাড়া কেউ ঘুমুতে পারে না।
সন্ধ্যাবেলা জাহেদ তার মামাকে মেন্টাল হামে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এল। তিন হাজার টাকা অগ্ৰীম জমা দিতে হল। দৈনিক তিনশ টাকা হিসেবে দশ দিনের ভাড়া। এই তিনশ টাকার মধ্যে খাওয়া খরচ ধরা নেই। মনোয়ারা তার গয়না বিক্রি করলেন। বেবীটেক্সী ভাড়া করে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি ঘুরতে লাগলেন ধারের জন্যে।
বিপদ একদিকে আসে না। নানানদিকে একসঙ্গে এসে সাঁড়াশি আক্রমণ করে। মিজান সাহেবের বাড়িওয়ালা জাহেদকে নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গেলেন। চা খাওয়ালেন, পাপড় ভাজা খাওয়ালেন। অমায়িক ভঙ্গিতে বললেন, আপনার মামার খবর শুনলাম। খুবই দুঃখ পেয়েছি। দুঃখ পাবারই কথা। অতি ভদ্রলোক ছিলেন। মাসের তিন তারিখে মাসের ভাড়া পেয়েছি। কোন দিন দেৱী হয় নাই। শেষ কয়েকমাসে কিছু সমস্যা হয়েছে। সমস্যা হতেই পারে। দিনতো সমান যায় না। সাগরে যেমন জোয়ার ভাটা আছে–মনের জীবনেও জোয়ার ভাটা আছে। সবই বুঝি। কিন্তু জাহেদ সাহেব, আমার ব্যবস্থাটা কি?
জাহেদ বলল, একটু সময় দিন। মামার অফিসে লোনের জন্য দরখাস্ত করছি— লোনটা পেলে প্রথমেই আপনার টাকাটা দিয়ে দেব।
আমাকে টাকা দিলেতো আপনার চলবে না। আপনাদের খরচপাতিও আছে না। পাগলের চিকিৎসা খুবই খরচের চিকিৎসা। আগে যক্ষা ছিল রাজরোগ এখন রাজরোগ হল পাগলামী। আমাকে কোন টাকা পয়সা দিতে হবে না।
বলেন কি?
সত্যি কথা বললাম ভাই। আমিও ভদ্রলোকের ছেলে। মানুষের বিপদ-আপদ বুঝি। আমাকে কোন টাকা পয়সা দিতে হবে না। তবে এই মাসের ২৮ তারিখের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। আমি অন্য জায়গায় ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। ৩০ তারিখে ভাড়াটে চলে আসবে।
কি সর্বনাশের কথা।
কোন সর্বনাশের কথা না ভাই। বাস্তব কথা। বাস্তব অস্বীকার করতে নাই। বাস্তব স্বীকার করে নিতে হয়। এখনো তিন চার দিন সময় আছে। একটা বাসা ঠিক করে উঠে চলে যান। আমি আপনাকে সাহায্য করব। আমার ট্রাক আছে। ট্রাক দিয়ে মালপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করব। একটা পয়সা লাগবে না। শুধু পেট্রোলের খরচ হিসাবে কিছু ধরে দেবেন।
জাহেদ বলল, আপনিতো ডেনজারাস লোক।
উপকার করতে গেলে ডেনজারাস লোক হতে হয়। এইজন্যে উপকার করতে নাই। ছমাসের ভাড়া মাফ করে দিলাম। এটা চোখে পড়ল না? নেন। ভাই ধরেন। সিগারেট খান। না-কি ধূমপান করেন না?
জাহেদ সিগারেট নিল না। তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। সামান্য সিগারেটের ধুয়াতো সেই ভাঙ্গা আকাশের কিছু হবে না।
ভাইসাহেব এই হল আমার বক্তব্য। চা আরেক কাপ দিতে বলব?
বলুন।
শুনেছি আপনিও বিবাহ করেছেন?
ঠিকই শুনেছেন।
জাহেদ কেয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেল। কেয়ার দুলাভাই ঘরে ছিলেন। তিনি কঠিন ভঙ্গিতে বললেন, কি খবর?
জাহেদ বলল, ভাল।
বোস।
জাহেদ বসল। ভদ্রলোক শুকনো গলায় বললেন, তোমার ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। স্ত্রীকে এখানেই ফেলে রাখবে?
জ্বি না–একটু সমস্যা যাচ্ছে। সাময়িক সমস্যা। বাড়ি ভাড়া করেছি। সামনের সপ্তাহে নিয়ে যাব।
কোথায় বাড়ি ভাড়া করেছ?
ইয়ে সোবাহান বাগ। ফ্ল্যাট বাড়ি। দুই রুম। দুই বাথরুম।
ভাড়া কত?
ইয়ে ভাড়া এখানো সেটল হয় নাই–দুই হাজার চাচ্ছে —মনে হয় কিছু কমবে। ফানিচার টানিচার এখনো কেনা হয়নি। এইসব কেনা কাটা করছি। কেয়া কি আছে? গুলশান মাকেট থেকে কিছু ফার্নিচার কিনব। ভাবছি। ওকে সঙ্গে নিয়েই কিনি।
ও যেতে পারবে না। জ্বর।
জ্বর না-কি?
গোসল করে সারারাত ঠাণ্ডা বাতাসে বসে বুকে ঠাণ্ডা বাঁধিয়েছে। কারো কথা তো শুনে না।
কেয়ার অনেক জ্বর। তবু সে বলল, সে যাবে। কেয়ার বড় বোন বললেন, তুই কি অসুখ আরো বাড়াতে চাস? ডাক্তার বলে গেল নিউমোনিয়ার লক্ষণ।
কেয়া বলল, ঘরে বসে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। একটু ঘুরে আসি।
তুই ইচ্ছা করে অসুখ বাড়াচ্ছিস।
আমি চলে আসব। আপা।
কেয়া বলল, হুড ফেলে দাও।
জাহেদ বলল, এই অবস্থায় হুড ফেলে দেব কি? তোমারতো সিরিয়াস ঠাণ্ডা লাগবে।
লাগুক।
তুমি আমার হাত ধরে বসে থাক। আজ অনেকক্ষণ ঘুরব। তুমি ভাল আছ তো?
আছি।
নীল শার্টটা কিনেছ?
না, এখনো কিনিনি।
এখনো কেননি। কবে কিনবে?
খুব শিগগীরই কিনব।
দুলাভাইকে যে দুরুমের ফ্ল্যাটের কথা বলছিলে–বানিয়ে বানিয়ে বলছিলে, তাই না?