তুমি চিনবে না, মা। আমার বন্ধু ছিল সাবের–ওর বড় বোন।
রেহানা বললেন, শুভ্ৰ, আমার শোবার ঘরের টেলিফোন নাম্বার তুই সবাইকে দিয়ে বোড়বি না। অপরিচিত কারোর টেলিফোন ধরতে আমার ভাল লাগে না। কাউকে যদি টেলিফোন দিতেই হয়–একতলারটা দিবি।
আচ্ছা।
আমার কথায় আবার রাগ করলি না তা শুভ্র?
না, রাগ করি নি। তোমার উপর তো আমি কখনো রাগ করি না, মা।
রেহানা বললেন, অন্যায় কিছু বললেও রাগ করবি না?
না।
কেন?
আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই, মা। আমি রাগ করলে তুমি যাবে কোথায়?
রেহানার চোখে পানি এসে গেল। তিনি চট করে অন্যদিকে তাকালেন। ছেলেকে তিনি তাঁর চোখের পানি দেখাতে চান না। শুভ্ৰ টেলিফোন ধরল।
হ্যালো, নীতু আপা?
হ্যাঁ।
তুমি কেমন আছ?
ভাল আছি।
তোমাকে কখনো টেলিফোন করে পাওয়া যায় না। যখনই টেলিফোন করি, আমাকে বলা হয়, তুমি বাসায় নেই। কিংবা তুমি ঘুমুছ। বাসায় যখন থাক তখন কি সারাক্ষণ তুমি ঘুমিয়েই থাক?
শুভ্ৰ হাসল।
নীতু বলল, শুভ্ৰ, তোমাকে আমার খুব দরকার। না ঠিক আমার না, আমার বাবার দরকার।
উনার কি শরীর ভাল নেই?
উনার কিছুই ভাল নেই। উনি গত দুদিন ধরে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করেছেন।
কেন?
উনি ঠিক করেছেন–অন্যহারে থেকে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন। এক চৈনিক কবিও না-কি তাই করেছেন। কবির নাম হল–লিয়াও সিন কিংবা লিয়াও বিনি। তুমি কি আসতে পারবে?
পারব।
বাবা তোমাকে কিছু বলতে চান। তুমি দয়া করে শোন উনি কি বলতে চাচ্ছেন।
আপা, আমি আপনাকে একটা খুব জরুরি কথা বলতে চাই।
আমাকে আবার কি জরুরি কথা?
আপনি চুপ করে শুনুন। দয়া করে রাগ করবেন না।
এমন কি কথা যে রাগ করার প্রশ্ন আসে?
আমি আপনাকে খুব পছন্দ করি।
এটা তো রাগ করার মত কথা না, শুভ্ৰ। খুশি হবার মত কথা। আমি তোমাকে পছন্দ করি। বাবা তোমাকে যতটা পছন্দ করেন ততটা হয়ত না। কিন্তু কমও না।
আমি যে আপনাদের বাসায় প্রায়ই যাই–চাচার সঙ্গে দেখা করতেই যাই। কিন্তু যখন দেখি আপনি বাসায় নেই তখন ভয়ংকর খারাপ লাগে।
ও আচ্ছা। প্রায়ই আমি আপনাকে স্বপ্নে দেখি। কাল রাতেও দেখেছি।
শুভ্ৰ, তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমি বুঝতে পারছি না। তোমার শরীর ভাল তো!
হ্যাঁ, শরীর ভাল। নীতু আপা, এখন আমি আপনাকে একটা ভয়াবহ কথা বলব।
ভয়াবহ কথা তুমি বলে ফেলেছ বলে আমার ধারণা।
না, বলিনি। এখন বলব। নীতু আপা, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
নীতু চুপ করে রইল। মনে হচ্ছে হঠাৎ টেলিফোন ডেড হয়ে গেছে। শুভ্র বলল, আপনি কি আমার কথা শুনতে পেয়েছেন?
হ্যাঁ–
আপনি কি রাগ করেছেন?
টেলিফোনে না। মুখোমুখি আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব।
আমি কি এখন আসব?
না এখন না। কাল এসো। আমার কোন ভাল শাড়ি নেই। শুভ্ৰ, আমি সুন্দর একটা শাড়ি কিনব। আজই কিনব। কি রঙ তোমার পছন্দ বলতো?
নীতু আপা, আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন?
বুঝতে পারছি না। তুমি আমার মাথা এলোমেলো করে দিয়েছ। তুমি কাল এসো। কাল আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব। রাখি শুভ্ৰ।
জাহেদ মহাবিপদে পড়েছে
জাহেদ মহাবিপদে পড়েছে। মিজান সাহেব দেশের বাড়িতে পৌঁছে ঘোষণা দিয়েছেন–এখানেই থাকবেন–আর শহরে ফিরবেন না। গ্রামে থাকার ব্যবস্থা নেই বললেই হয়। টিনের ঘর দুটির ভগ্নদশা। ভিটের ভেতর মানুষ সমান ঘাস গজিয়েছে। বাড়ির দরজা জানালা লোকজনে খুলে নিয়েছে। খাট-চৌকি কিছুই নেই। মেঝেতে বিছানা করে ঘুমুতে হবে। মেঝেময় গর্ত। সাপের না ইদুরের, কে বলবে?
জাহেদ বলল, এর মধ্যে কি থাকবে? চল কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি গিয়ে উঠি। খাওয়া-দাওয়াতো করতে হবে। খাব কি? এখানেতো আর হোটেল নেই।
ব্রেইন ডিফেক্ট হয়েছে, নিজের ভাঙ্গা বাড়িই হচ্ছে অট্টালিকা। এইখানেই থাকব।
আর খাওয়া-দাওয়া?
হাড়িকুড়ি কিছু আন। ইট পেতে আগুন করে রান্না হবে। পিকনিক হবে, বুঝলি? রোজ পিকনিক। নিজের বাড়ি থাকতে অন্যের বাড়ি আমি খাব না। শেষে বিষ-টিষ মিশিয়ে দেবে।
বিষ মিশাবে কেন?
আরো গাধা, চারদিকে শত্ৰু। জমিজমা সব বেদখল হল কি জন্যে? কারা এইসব নিলা? তবে এসেছি। যখন সব শায়েস্ত করে যাব। দরকার হলে মার্ডার করব। মামা ভাগ্নে যেখানে বিপদ নেই সেইখানে। কিরে, পারবি না। আমাকে সাহায্য করতে?
জাহেদ চোখে অন্ধকার দেখছে। একি সমস্যা।
রাতে থাকার জন্যে চৌকি জোগাড় করা হয়েছে। চৌকির উপর তোষক বিছিয়ে বিছানা। খাবার ব্যবস্থা জাহেদের দূর সম্পকের এক খালার বাসায়। মিজান সাহেব কিছুতেই সেখানে খেতে যাবেন না। জাহেদ এক গিয়ে খেয়ে এল। বাটিতে করে খাবার নিয়ে এল। মিজান সাহেব সেই খাবারও মুখে দিলন না। চোখ কপালে তুলে বললেন, অসম্ভব। তুই কি আমাকে মারতে চাস? স্বপাক আহার করব। নিজে রোধে খাব ।
তৃতীয় দিনের দিন সে প্রায় জোর করেই মামাকে নিয়ে ঢাকায় এসে নামল। ট্রেন থেকে তিনি নামলেন বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায়। রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালাকে করুণ গলায় বললেন, এরা আমাকে খুন করতে নিয়ে যাচ্ছে, বুঝলেন ভাই সাহেব। গ্রামের বাড়িতে সুখে ছিলাম, ভুলিয়ে ভালিয়ে এনেছে। গরু জবেহ করার বড় ছুরি আছে না? ঐটা দিয়ে জবেহ করবে। ঘুমের মধ্যে কাম সারবে। আল্লাহ হু আকবর বলে গলায় পোচ।
তিনি বাসায় ঢুকলেন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। মনোয়ারাকে দেখে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কি রে মাগী–স্বামীকে খুন করাতে চাস? বেশ, খুন কর। কিছু বলব না। চিৎকারও দিব না। তবে খিয়াল রাখিস, আল্লাহর কাছে জবাব দিহি করতে হবে। খুনের সময় আমাকে কিন্তু উত্তর দক্ষিণে শোয়াবি। ভালমত গোসল দিবি। নাপাক অবস্থায় আল্লাহর কাছে যেতে চাই না।