না, অপরিচিত লাগছে না। আমার এক পরিচিত মেয়ের নাম নীতু। আমি আমার জীবনে এত ভাল মেয়ে দেখিনি।
ভাল মেয়ে বলতে কি বুঝাচ্ছেন? ভাল ছাত্রী?
সবকিছু নিয়েই ভাল। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে গেলে মনে পবিত্র ভাব হয়। নীতু আপা তাদের মধ্যে একজন।
উনি আপনার আপা হন?
জ্বি। আমার বন্ধুর বড় বোন।
আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন। বসুন, বসে বসে আপনার নীতু আপার গল্প করুন।
শুভ্ৰ বসল। সে হঠাৎ লক্ষ্য করল আনুশকার সঙ্গে গল্প করতে তার ভাল লাগছে। ভাল লাগার অনেক কারণের মধ্যে একটি হয়ত এই যে মেয়েটি খুব আগ্ৰহ নিয়ে শুভ্রের গল্প শুনছে।
রিয়া এক ফাঁকে এসে দুজনের হাতে দুগ্রাস কোক ধরিয়ে দিয়ে কানে কানে শুভ্রকে বলল, মেয়েটা দারুণ না? পছন্দ হচ্ছে?
শুভ্ৰ হাসল। রিয়া বলল, ভাল কথা, খুব ভাল এক বোতল শ্যাম্পেন আছে। বোতলটা নিউ ইয়ার্স ডেতে খোলা হবে ভেবেছিলাম–তোর খালু খুলে ফেলেছে। শুভ্ৰ, তুই কি এক চুমুক খেয়ে দেখবি?
না।
আচ্ছা বাবা, যা খেতে হবে না। তুই নীতুর সঙ্গে গল্প কর। গল্প করতে করতে যদি তোর ইচ্ছা করে নীতুর হাত ধরতে–ধরতে পারিস। নীতু কিছুই মনে করবে না। তাই না নীতু?
নীতু হাসতে হাসতে বলল, আমি কিছু মনে করব না। কিন্তু শুভ্র কখনোই আমার হাত ধরতে চাইবে না।
রিয়া বলল, কে বলেছে চাইবে না? খুব চাইবে।
উঁহু। পুরুষ মানুষ আমি খুব ভাল চিনি। ওরা তাদের নিজেদের যতটা চেনে আমি তারচেয়েও বেশি চিনি। শুভ্র সাহেব নীতু নামের একজনের হাত ঠিকই ধরতে চাচ্ছেন, সেই একজন আমি নই।
শুভ্ৰ অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। আশ্চর্য! মেয়েটি ঠিক কথাই বলেছে। এই নীতুর দিকে তাকিয়ে সে নীতু আপার কথাই ভাবছিল। কি আশ্চর্য কথা! তার হাত থেকে ছলকে খানিকটা কোক সাদা পাঞ্জাবীতে পড়ে গেল। নীতু শব্দ করে হেসে উঠল।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কে যেন কাঁদছে
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কে যেন কাঁদছে।
মাহিন সাহেব কান্নার শব্দ শুনছেন। সব শব্দ তাঁর চেনা। এই কান্নার শব্দ অপরিচিত। অবশ্যি তিনি জানেন কে কঁদছে। এ বাসায় তিনি ছাড়া আর একজন মানুষই বাস করে–নীতু। নীতুই কাঁদছে। নীতু ছাড়া আর কে হবে? কিন্তু এরকমভাবে কাঁদছে কেন? মাহিন সাহেব ডাকলেন, নীতু। নীতু!
নীতু দরজা ধরে দাঁড়াল। মাহিন সাহেব বললেন, কি করছিলি?
রুটি বানাচ্ছিলাম। তুমি রুটি খাবে রাতে।
কাঁদছিলি নাকি?
না, কাঁছিলাম না। কথায় কথায় আমি কাঁদি না। তাছাড়া কাঁদার মত কিছু হয়ওনি।
আমি ভুল শুনলাম?
হ্যাঁ, তুমি ভুল শুনেছ। অনেক দিন থেকেই তুমি ভুল চিন্তা করছিলে। এখন তুমি ভুল শোনাও শুরু করেছ।
আয় আমার কাছে। বোস।
আমার রুটি বানাতে হবে, বাবা।
রুটি পরে বানালেও হবে। না বানালেও অসুবিধা নেই। রাতে আমি কিছু খাব না। তুই আমার কাছে এসে বোস।
নীতু বাবার কাছে বসল। মাহিন সাহেব বললেন, মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছা করে তোর মাথায় হাত রেখে আদর করি। ইচ্ছা করলেও পারি না। মহাশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা আমার সেই অধিকার হরণ করেছেন।
নীতু বলল, তুমি কি কোন দীর্ঘ বক্তৃতা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছ, বাবা? দীর্ঘ বক্তৃতা শোনার ইচ্ছা আমার নেই। ছোটবেলা থেকে তোমার দীর্ঘ বক্তৃতা এত শুনেছি যে বক্তৃতা ব্যাপারটা থেকে আমার মন উঠে গেছে।
তাও আমি জানি। বক্তৃতা দেয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি। এখন আমি আমার সব কথা শুভ্রর জন্যে জমা করে রাখি। সে এলে তাকে বলি।
ভাল। কথা শোনাবার একজন কেউ আছে।
তোর নেই?
না, আমার নেই। আমার কথা শোনাবার কেউ নেই।
মাহিন সাহেব গলার স্বর তীক্ষ্ণ করে বললেন, যে ছেলেটিকে তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস সে তোর কথা শুনে না?
তাকে কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। সবাইকে সবকিছু বলা যায় না। আমি এখন যাই–তোমার খাবার রেডি করি।
কিছু রেডি করতে হবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিছু খাব না।
সিদ্ধান্ত কখন নিলে?
গতকাল নিয়েছি। আজ তা কার্যকর করতে যাচ্ছি।
তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে তুমি খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছ?
হ্যাঁ।
কেন?
আমার পক্ষে এক এক বাস করা সম্ভব না। আমি একজন পরজীবী। রাস্তায় ভিক্ষা করে জীবনযাপন করব তাও সম্ভব না। অবাস্তব পরিকল্পনা।
না খেয়ে থাকার পরিকল্পনা বাস্তব?
এটি অবাস্তব, তবে আমি কোন বিকলাপ পাচ্ছি না।
না খেয়ে না খেয়ে তুমি মারা যাবে এটিই কি তোমার পরিকল্পনা?
হ্যাঁ। তবে মৌলিক পরিকল্পনা না। আমার আগেও একজন তা করে গেছেন। তাঁর নাম লিয়াওসিন–চৈনিক কবি। তিনি অবশ্যি করে গেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। তিনি মৃত্যু কি, মৃত্যু কিভাবে মানুষকে গ্রাস করে তা জানার জন্য উপবাস শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকেন। তুই কি শুনতে চাস তার অভিজ্ঞতার কথা?
না।
তোর শুনতে ভাল লাগবে। মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাবার সময় তিনি বেশকিছু ত্রিপদী কাব্য রচনা করেন। তার আক্ষরিক অনুবাদ ইংরেজিতে করা হয়েছে। ইংরেজি থেকে আমি কিছু কিছু বাংলা করেছিলাম। শুনিবি?
না, শুনব না।
আচ্ছা একটা শোন–
দিন হল রাত্রি, এবং রাত্রি হল দিন ।
মাথার ভেতর উঠল বেজে এক সহস্ৰ বীণ।
নীতু উঠে চলে গেল। মাহিন সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি তঁর পরিকল্পনায় মোটামুটি স্থির। খাওয়া বন্ধ। এই ভাবেই তিনি এখন মৃত্যুর দিকে এগুবেন। সবাইকে মুক্তি দিয়ে যাবেন। কাউকে আনন্দ দেবার ক্ষমতা এখন তাঁর নেই কিন্তু মুক্তি দেবার ক্ষমতা তীর অবশ্যই আছে। আবারো কান্নার শব্দ শুনছেন। রান্নাঘর থেকে কান্নার শব্দ আসছে। নীতুই কাঁদছে।