শুভ্র বলল, তাকিয়ে আছ কেন মা?
রেহানা বললেন, মানুষ তো একে অন্যের দিকে তাকিয়েই থাকবে, বোকা। কখনো কি দেখেছিস দুজন চোখ বন্ধ করে মুখোমুখি বসে আছে?
শুভ্ৰ হাসল। রেহানা চোখ ফিরিয়ে নিলেন। শুভ্র যখন হাসে, তিনি চোখ ফিরিয়ে নেন। মা-বাবার নজর খুব বেশি লাগে। তাঁর ধারণা, শুভ্রকে হাসতে দেখলেই তিনি এত মুগ্ধ হবেন যে নজর লেগে যাবে।
শুয়ে পড়, শুভ্ৰ।
ঘুম আসছে না মা। ঘুমের চেষ্টা করলে ঘুম আরো আসবে না। কাজেই আমি ঘণ্টাখানিক জেগে থাকব। একটা কঠিন বই পড়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমুতে যাব।
এত রাতে বই পড়বি? চোখের উপর চাপ পড়বে তো।
পড়ুক চাপ। যে ভাবে চোখ খারাপ হচ্ছে, আমার মনে হয়, এক সময় অন্ধ হয়ে যাব। অন্ধ হয়ে যাবার আগেই যা পড়ার পড়ে নিতে চাই মা।
রেহানার বুক ধক করে উঠল। শুভ্ৰকে কঠিন ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না। ধমক দিলে বা কঠিন কিছু বললে শুভ্ৰ বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে। দেখতে খুব খারাপ লাগে।
মা।
কি।
তুমি কি আমাকে হালকা করে এক কাপ চা খাওয়াতে পারবে।
এত রাতে চা খেলে তো বাকি রাত আর ঘুমুতে পারবি না।
ঘুমুতে না পারলেই ভাল। বইটা শেষ করে ফেলতে পারব।
চায়ের সঙ্গে কিছু খাবি?
হ্যাঁ। এক স্লাইস রুটি গরম করে দিও। রুটির ওপর খুব হালকা করে মাখন দিতে পার। চিনি দিও না। গোল মরিচের গুড়া ছড়িয়ে দিও।
ইয়াজউদ্দিন বারান্দায় বসে আছেন। এ্যাসপিরিন খাননি। তবে দুটা ফ্রিজিয়াম খেয়েছেন। নিজেই শোবার ঘরে ঢুকে ট্যাবলেট বের করেছেন। হাতের কাছে পানি ছিল না। তেতুলের সরবত দিয়ে ট্যাবলেট গিলতে হয়েছে। ঘুমের অষুধ খাবার আধঘণ্টা পর বিছানায় যেতে হয়। তিনি আধঘণ্টা পার করার জন্যে অপেক্ষা করছেন। তার ঘুম এসে গেছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে। কয়েকবার হাই উঠেছে।
তিনি দেখলেন রেহানা টেতে করে চা নিয়ে শুভ্রের ঘরে ঢুকছে। ইয়াজউদ্দিন সাহেবের ভ্রূ কুঞ্চিত হল। দুপুর রাতে সে ছেলেকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছে কেন? অন্ধ ভালবাসার ফল কখনো মঙ্গলময় হয় না। এই ব্যপারটা রেহানা কি জানে না? তিনি নানানভাবে নানান ভঙ্গিতে রেহানাকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। রেহানা কিছুই বুঝেনি। তাঁর নিজের শরীর ভাল যাচ্ছে না। যে কোন সময় ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যেতে পারে। তখন হাল ধরতে হবে শুভ্রকে। শুভ্রর সেই মানসিক প্রস্তুতি নেই। সে এখনা শিশু। রেহানা কি সেই শিশুকেই নানানভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে না?
রেহানা এসে স্বামীর সামনে দাঁড়ালেন, কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বললেন, শুভ্র চা খেতে চাচ্ছিল, কি একটা বই না-কি পড়ে শেষ করবে।
ইয়াজউদ্দিন ঠাণ্ডা গলায় বললেন, চল, ঘুমুতে যাই।
তোমার শরীর কি এখন ভাল লাগছে?
হুঁ।
কাল সকালে একজন ডাক্তার দেখিও।
দেখাব।
তাঁরা শোবার ঘরে ঢুকলেন। রেহানা বলল, ফ্যান থাকবে, না বন্ধ করে দেব? জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে। ফ্যান বন্ধ করে দি?
দাও।
তাঁরা ঘামুতে গেলেন। ইয়াজউদ্দিন পায়ের উপর পাতলা চাদর টেনে দিলেন। তিনি নিজে এখন খানিকটা বিষণু বোধ করছেন। তাঁর শরীর খারাপ করেছিল। বেশ ভালই খারাপ করেছিল। কে জানে হয়ত ছোটখাট একটা স্ট্রোক হয়েছে। তিনি নিজে সে ধাক্কা সামাল দেবার চেষ্টা করেছেন। রেহানাকে বুঝতে দেননি। তিনি কাউকে বিচলিত করতে চান না। তবু খানিকটা বিচলিত রেহানা হতে পারত। সে তার ছেলেকে বলতে পারত–তোর বাবার শরীরটা ভাল না। বারান্দায় বসে আছে। তুই যা, বাবার সঙ্গে কথা বলে আয়। রেহানা কিছুই বলেনি। বললে শুভ্র বারান্দায় এসে বসত। উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করত, বাবা, তোমার কি হয়েছে?
ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারলে তাঁর ভাল লাগতো। রেহানা তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি। ইয়াজউদ্দিন সাহেবের ধারণা, রেহানা তাঁকে ভালমত লক্ষ্য করে না। তাঁর আচার-আচরণ নিয়ে ভাবেও না। যদি ভাবত তাহলে লক্ষ্য করতো–দ্বিতীয়বার বারান্দায় এসে তিনি মাঝখানের চেয়ারে বসেছেন। কেন বসেছেন? দুপাশে দুটি চেয়ার খালি রেখে তিনি কেন বসলেন? উত্তর কি খুব সহজ নয়? তিনি চাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী এবং পুত্র তার দুপাশে বসুক।
রেহানা।
হুঁ।
শুভ্রর বয়স কত হল?
সাতাইশ বছর তিন মাস।
ইয়াজউদ্দিন নিঃশব্দে হাসলেন। ছেলের বয়স বছর এবং মাস হিসেবে রেহানা জানে। সে কি তার স্বামীর বয়স জানে? তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়–আমার বয়স কত রেহানা? সে কি বলতে পারবে?
রেহানা বললেন, ওরা এখন একটা বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়?
ও কি বিয়ের কথা কিছু বলছে?
না, বলছে না। ওকে বলতে হবে কেন? বিয়ের বয়স তো হয়েছে। সাতাশ বছর তো কম না…
অনেকের জন্যে খুবই কম। সাতাশ বছরেও অনেকে সাত বছর বয়েসী শিশুর মত থাকে।
শুভ্রকে নিশ্চয়ই তুমি শিশু ভাব না?
ইয়াজউদ্দিন জবাব দিলেন না। বুকের চাপ ব্যথাটা আবার ফিরে এসেছে। একইসঙ্গে চোখ জড়িয়ে আসছে ঘুমে। ফ্যান বন্ধ করে দেয়া ঠিক হয়নি। গরম লাগছে। ভ্যাপস ধরনের গরম।
রেহানা উৎসুক গলায় বললেন, ঘুমিয়ে পড়েছ?
না।
তোমার কি জাভেদ সাহেবের কথা মনে আছে? পুলিশের এ আই জি ছিলেন–বিয়ে করেছেন বরিশালে। মনে আছে?
আছে।
উনার এক ভাগ্নি আছে। ডাক নাম শাপলা–মেয়েটা খুব সুন্দর, টিভিতে গান গায়। বি গ্রেডের শিল্পী। নাটকও করে। ও লেভেল পাস করে ইউনিভাসিটিতে ঢুকেছে। পালিটিক্যাল সায়েন্সে পড়ে। থার্ড ইয়ার। গায়ের রঙ শুভ্রের মত না হলেও ফর্সা। তুমি কি মেয়েটাকে দেখবে?