মাহিন সাহেবের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। শুভ্ৰ অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মাহিন সাহেব বললেন, আজ তুমি যাও। দরজায় তালা দিয়ে যাও।
আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে দেব?
দাও।
শুভ্র আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে মাহিন সাহেবের ঠোঁটে খুঁজে দিল।
চাচা যাই?
আচ্ছা যাও। মে গড বি অলওয়েজ উইথ ইউ।
নীতু মাথা নিচু করে টাইপ করে যাচ্ছে। সেকশনাল ইনচার্জ পরিমল বাবু একগাদা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন, লাঞ্চের আগে শেষ করতে পারবেন না? নীতু হতাশ চোখে কাগজগুলির দিকে তাকিয়েছে। লাঞ্চের আগে শেষ করার প্রশ্নই ওঠে না। মুখের উপর না বলাও সম্ভব না।
একটু স্পীডে টাইপ করে যান। মন লাগিয়ে স্পীড করলে লাঞ্চের আগেই পারবেন। তিনটা করে কপি করবেন।
নীতু কথা বলে সময় নষ্ট করল না। টাইপ শুরু করল। তার স্পীড ভাল। কিন্তু আজ স্পীড উঠছে না। শুভ্র চলে আসতে পারে। আজ না এলে ভাল হত। যদি আসে সে কি করবে! চলে যেতে বলবে? অন্য একদিন আসতে বলবে? শুভ্রের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
এক ঘণ্টা নীতু সমান তালে টাইপ করে গেল। মুহুর্তের জন্যেও থামল না। এখনা একগাদা কাগজ সামনে। পাঁচজন টাইপিস্ট আছে। কাগজগুলি সবার মধ্যে ভাগ করে দেয়া যেত। . . .
নীতু আপা!
কেয়া মুখ তুলে তাকাল। ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি এসেছ?
জ্বি।
চল, ক্যানটিনে গিয়ে বসি।
নীতু উঠে দাঁড়াল। পাশের টেবিলের ইদারিস সাহেবকে বলে গেল সে ক্যান্টিনে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরবে।
তালাবন্ধ করে এসেছ শুভ্র?
জ্বি।
অসুস্থ একজন মানুষকে তালাবন্ধ করে রেখে আসতে হচ্ছে। চিন্তা করতেই খারাপ লাগে। ব্যবস্থাটা অবশ্যি সাময়িক।
ক্যান্টিন ফাঁকা। নীতু কোণার দিকের একটা চেয়ারে বসল। নোংরা ক্যান্টিন। মনে হচ্ছে তিন-চারদিন ধরে মেঝে বটিট দেয়া হচ্ছে না। টেবিলে টেবিলে চায়ের কাপ। মাছি উড়ছে।
কিছু খাবে শুভ্ৰ?
জ্বি না।
এরা খুব ভাল সিঙ্গারা বানায়। আমি লাঞ্চে দুটা সিঙ্গারা আর এক কাপ চা খাই। খেয়ে দেখো না।
আচ্ছা বলুন, সিঙ্গারা দিতে বলুন।
নীতু উঠে গিয়ে সিঙ্গারা নিয়ে এল। শুধু সিঙ্গারা নয়, এক বোতল পেপসিও আছে।
শুভ্ৰ, পেপসি খাও তো তুমি?
জ্বি খাই।
খুব ঠাণ্ডা হবে না। সিঙ্গীরা খেয়ে পেপসিটা খাও। এখানকার পানি ভাল না।
কি জন্যে ডেকেছেন, আপা?
বাবা সম্পর্কে তোমার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে। তুমি তো প্রায়ই বাবার সঙ্গে কথা বল। আজও বললে, কিছু বুঝতে পারছ? কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করেছ?
জ্বি-না। কি পরিবর্তনের কথা বলছেন?
বাবার মাথা ঠিক নেই, শুভ্ৰ। বাসায় তালা দিয়ে আসার এও একটা কারণ। আমাদের বাড়িতে এমন কিছু মহামূল্যবান কোহিনুর নেই যে ঘর তালাবন্ধ করে আসতে হবে। বাবার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।
উনি কি করেন?
এখনো কিছু করছেন না। তবে খুব শিগগিরই করবেন। বাবা হুট করে কিছু করেন না। কোন একটা বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন চিন্তা-ভাবনা করেন। তারপর কাজটা করেন। তখন হাজার যুক্তি দিয়েও তাঁকে টলানা যায় না। এখন তিনি কি ভাবছেন শুনবে? এখন ভাবছেন তিনি আমাদের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে আছেন। তিনি আমাদের মুক্তি দিতে চান। তোমাকেও নিশ্চয়ই বলেছেন।
হ্যাঁ, বলেছেন।
মার সঙ্গে এই নিয়ে ঝগড়া হল। মা কান্নাকাটি করে বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। এখন মা ছোটমামার সঙ্গে আছেন। মাকে কি বলেছেন শুনবো?
বলুন।
মাকে বলেছেন–আমি তোমাদের কাছে বিরাট বোঝা। আমার জন্যে নীতুর বিয়ে হচ্ছে না। আমি চাই না। আমার জন্যে আমার মেয়ের জীবন নষ্ট হাক। কাজেই আমি ঠিক করেছি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তুমি আমাকে লোকজন বেশি চলাচল করে এমন একটা রাস্তার পাশে শুইয়ে রেখে এসো। এ শহরে খুব কম করে হলেও পঞ্চাশ হাজার ভিক্ষুক বাস করে। রোড এ্যাকসিডেন্টে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, অনাহারে ভিক্ষুকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় না। আমি এইভাবে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারব বলে আমার ধারণা। মা বললেন, তোমাকে মুখে তুলে কে খাইয়ে দেবো? বাবা বললেন, তিনি পাটনারশীপ ব্যবস্থায় আরেকজন অল্পবয়স্পর্ক শিশু ভিক্ষুক সঙ্গে নেবেন। বাবার রোজগারের অর্ধেক সে পাবে। বিনিময়ে বাবাকে সে খাইয়ে দেবে। বাবার মাথা যে পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে তুমি কি বুঝতে পারছি? তুমি চিন্তা করতে পার–এই লোক ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছে।
শুভ্র বলল, এমন কিছু ঘটেছে যার জন্যে চাচা হঠাৎ করে মনে করা শুরু করলেন যে তিনি বাড়তি বোঝা।
বাবা তো বোকা না শুভ্ৰ। বাবা যথেষ্টই চালাক। তাছাড়া শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের বুদ্ধি হঠাৎ করে অনেকখানি বেড়ে যায়। বাবা এক ধরনের বোঝা তো বটেই। তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মত। তবু তোমাকে বলি–আমার বিয়ে করার একটা সুযোগ ঘটেছে। কোনদিন ঘটবে আমি ভাবিনি, কিন্তু ঘটেছে। আগে একবার বিয়ে হওয়া মেয়ের আবার বিয়ে ঠিক হওয়া বড় ঘটনা। যার সঙ্গে বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছে–তার মা-বাবা আছে। ছোট ভাইবোন আছে। আমি তো বিয়ের পর মাবাবাকে নিয়ে ঐ বাড়িতে উঠতে পারি না।
উনি তো আপনার সমস্যা জানেন। উনি কি বলছেন?
সে কিছুই বলছে না। আমি তাকে অপেক্ষা করতে বলছি। কতদিন সে অপেক্ষা করবে? তাছাড়া অপেক্ষা করবেই বা কেন?।
শুভ্ৰ পেপসির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলল, আপনি তাকে অপেক্ষা করতে বলছেন কেন? আপনার কি ধারণা অপেক্ষা করলেই সমস্যার সমাধান হবে?