জ্বি আচ্ছ।
মাহিন সাহেব উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মাথাভর্তি ধবধবে সাদা চুল। দুসপ্তাহ শেভ করা হচ্ছে না বলে মুখে খোঁচা-খোঁচা সাদা দাড়ি। গায়ের চাদরও সাদা রঙের বলে তাঁকে ঋষি-ঋষি দেখাচ্ছে।
চায়ে চিনি হয়েছে শুভ্র?
হয়েছে। আপনার শরীর আজ কেমন?
অসম্ভব ভাল।
রাতে নাকি ঘুম হয় নি?
রাতে আমার কখনা ঘুম হয় না। এরা জানে না। এই বয়সে ঘুম না হওয়া কোন বড় ব্যাপার না। শোন শুভ্ৰ, তোমার সঙ্গে আমি এখন খুব জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলব। খুব জরুরি। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সিদ্ধান্ত তোমাকে জানাব। খুব মন দিয়ে শোন।
আপনার সব কথাই আমি খুব মন দিয়ে শুনি।
একমাত্ৰ তুমিই শোন। আর কেউ শুনে না। দেখ শুভ্ৰ, আমি এই সংসারে উপদ্রবের মত আছি। পক্ষাঘাত সারার কোন সম্ভাবনা নেই। অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আগে বঁ হাতটা নাড়াতে পারতাম, এখন তাও পারি না। শরীর অসুস্থ হলে মনও অসুস্থ হয়। আমার মনও এখন অসুস্থ। রাত-দিন চোঁচামেচি করি। আমার চেচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে আমার স্ত্রী এক সপ্তাহ ধরে তাঁর ভাইয়ের বাসায় আছেন। কাজের মেয়ে ছিল। সে পালিয়েছে তিনদিন আগে। তুমি কি আমার কথা মন দিয়ে শূনছ?
শুনছি।
আমি এদের ঘাড়ে ভূতের মত চেপে আছি। সিন্দাবাদের ভূত। এরা আমাকে কি করে ঘাড় থেকে নামাবে বুঝতে পারছে না।
এরা আপনাকে ঘাড় থেকে নামাতে চাচ্ছে এরকম মনে করছেন কেন?
মনে করাই তো স্বাভাবিক। নীতু বিয়ে করতে পারছে না। আমার জন্যে। একটা ছেলের সঙ্গে তার ভাব-টাব হয়েছে বলে মনে হয়। ওদের অফিসেই কাজ করে। কয়েকবার এ বাড়িতে এসেছে। কখনো আমার সঙ্গে দেখা করেনি। নীতুর সঙ্গে গল্প করে চা-টা খেয়ে চলে গেছে। আমি যতদিন বেঁচে আছি। নীতু বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করতে পারবে না। এটা হল বাস্তব কথা। আমি ওদের মুক্তি দিতে চাই। বুঝলে শুভ্র? চির মুক্তি!
কিভাবে?
সেটা নিয়েই ভাবছি। আত্মহত্যা সহজ পথ, তবে খুবই নিম্নমানের পথ। আত্মহত্যা খুনের চেয়েও খারাপ। খুন করার পর অনুশোচনার একটা সুযোগ থাকে। আত্মহত্যার পর সেই সুযোগও থাকে না।
আপনি কি আত্মহত্যার কথা ভাবছেন?
এখনা ভাবছি না। অন্য পথ আর কি আছে খুঁজে বেড়াচ্ছি। পাচ্ছি না। আমি হয়েছি পরাশ্রয়ী। নিজে নিজে খেতে পারি না। অন্যকে খাইয়ে দিতে হয়। আমার কোন উপার্জন নেই। বেঁচে থাকার জন্যে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। আমার স্বাভাবিক মৃত্যু হলে সবদিক রক্ষা হত। চট করে তা হবে বলে মনে হয় না। আমার মানসিক শক্তি এখনো প্রবল। আমার মনে হচ্ছে, স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য আমাকে আরো সাত-আট বছর অপেক্ষা করতে হবে। সাত-আট বৎসর নীতু আমার জন্যে অপেক্ষা করবে–এটা উচিত না।
শুভ্ৰ বলল, আপনার জন্যে সিগারেট এনেছি। ধরিয়ে দেব?
দাও।
শুভ্ৰ সিগারেট ধরিয়ে মাহিন সাহেবের ঠোঁটে খুঁজে দিল। তিনি ধোঁয়া ছেড়ে তৃপ্তির গলায় বললেন, বেঁচে থাকতে আমার এখনো ইচ্ছা করে। এই যে ধোঁয়ার সঙ্গে নিকোটিন নিচ্ছি—শরীর আরাম পাচ্ছে। তোমার সঙ্গে কথা বলছি তাতেও আনন্দ পাচ্ছি। আনন্দের ব্যাপার এখনো আছে। তবে তাকে প্রশ্ৰয় দেয়া ঠিক হবে কি-না সেটাই বিচার্য। সমস্ত জীবজগতের একটা সহজ নিয়ম আছে। অসুস্থ, দুর্বল, অক্ষম কাউকে জীবজগৎ সহ্য করে না। সাধারণত তাকে মেরে ফেলে কিংবা এমন ব্যবস্থা করে যেন মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। একটা কাক অসুস্থ হলে অন্য কাকরা কি করে জান?
না।
তাকে ঠুকরে ঠুকরে মেরে ফেলে। অসুস্থ কাক কোন প্রতিবাদ করে না। চুপ করে বসে থাকে।
আপনি তা কাক না। আপনি মানুষ।
মানুষ হলেও আমি সমগ্র জীবজগতেরই একটা অংশ। জীবজগতের সবার জন্যে যা সত্যি–তা আমার জন্যেও সত্যি।
চাচা, আমার মনে হয় কোন কারণে আপনার মন-টন খারাপ বলে এ জাতীয় চিন্তা-ভাবনা করছেন।
সহজে আমার মন খারাপ হয় না। তবে এখন হচ্ছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে রেগে যাচ্ছি। এগারোই সেপ্টেম্বর দিন সাবেরের মৃত্যুদিন। এরা দেখি এই দিনটার কথা ভুলে গেছে। কারোর মনেই নেই কি অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে ছেলেটা আমার কোলে মারা গেল।
অনেক দিনের ব্যাপার চাচা।
হ্যাঁ, অনেক দিনের ব্যাপার। ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। মানুষ বিস্মৃতিপরায়ণ। ভুলে যাবার মধ্যেও সে আনন্দ পায়। কিন্তু তুমি তো ভুল নি শুভ্ৰ। তুমি তো ঠিকই উপস্থিত হয়েছ। হও নি? আজ কত তারিখ শুভ্ৰ–এগারোই সেপ্টেম্বর না?
শুভ্ৰ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে নরম গলায় বলল, ও আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। ওর কথা আমার প্রায়ই মনে হয়।
ও ছিল তোমার বন্ধু। কিন্তু সে ছিল এ পরিবারের একজন। এরা কেন তাকে ভুলে যাবে!
ভুলবে কেন। কেউ ভুলেনি।
সান্ত্বনা দেয়া কথা আমার ভাল লাগে না। তুমি সান্ত্বনার কথা আমাকে বলবে না। আমার এই ছেলেটির কথা কারো মনে নেই। মনে থাকলে এরা বুঝত কেন এই স্টোররুমে আমি থাকি। এদের ধারণা, আমি এখানে থাকি সবাইকে যন্ত্রণা দেয়ার জন্যে। কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না–এটা আমার ছেলের ঘর। সে এখানে থাকতো। ফ্যান নেই, আলো-বাতাস নেই—ছাট্ট একটা ঘরে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখতো। তুমি মাঝে মাঝে আমার কাছে আস–আমার এত ভাল লাগে! আমি আমার ছেলের ছায়া তোমার মধ্যে দেখি। ছেলেটা মরার সময় তুমি ছিলে না। ওর যন্ত্রণা যখন খুব তীব্র হত তখন সে আমাকে বলতো, বাবা, শুভ্র যদি আসে ওকে ঘরে ঢুকতে দিও না। ও মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। ও আমাকে দেখে কষ্ট পাবে।