মেয়েও কি তুমি ঠিক করে রেখেছ?
না, এখনো ফাইন্যাল করিনি। তবে দু-একজন যে নেই তাও না। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি–তোমার নিজের কোন পছন্দের মেয়ে থাকলে বলতে পার। তোমার মতামত গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করা হবে। রাত অনেক হয়েছে। যাও, শুয়ে পড়। আমার নিজেরো ঘুম পাচ্ছে।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব উঠে পড়লেন। তিনি অবশ্যি সরাসরি তাঁর শোবার ঘরে ঢুকলেন না। শোবার ঘরের লাগোয়া স্টাডি রুমে ঢুকলেন। নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়ায় ঘুম চলেগেছে। সময়মত ঘুমুতে না গেলে তাঁর বড় ধরনের সমস্যা হয়। ঘুম-ঘুম ভাব থাকে। কিন্তু ঘুম আসে না। ঘুম-ঘুম ভাব নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকার কোন মানে হয় না। তিনি শুভ্ৰর উপর তৈরি করা রিপোর্ট নিয়ে বসলেন। যাকে রিপোর্ট তৈরি করতে দিয়েছিলেন তাকে মনে মনে কয়েকবার গাধা বলে গালি দিলেন। তাঁর মনে হল রিপোটের কিছু-কিছু জায়গা বানানা। রিপোটের শুরুতেই লেখা–শুভ্র সাহেব বাড়ি থেকে বের হয়েই এক প্যাকেট সিগারেট কিনলেন।
শুভ্ৰ তা করবে না। সে সিগারেট খায় না। অবশ্যি হতে পারে যে অন্য কারো জন্যে কিনেছে। মাহিন নামের ঐ ভদ্রলোকের জন্যে?
রেহানা স্টাডি রুমে ঢুকলেন। অবাক হয়ে বললেন, এত রাতে এখানে বসে আছ কেন? ঘুঘুবে না?
ঘুমুব।
এসো শুয়ে পড়ি। আমার নিজের শরীরও ভাল না। জ্বর এসেছে বলে মনে হয়।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, আচ্ছা শুভ্র কি সিগারেট খায়?
না।
তুমি নিশ্চিত যে খায় না?
রেহানা হাসিমুখে বললেন, ও কি করে না করে আমি জানব না?
ইয়াজউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, না, ও কি করে না করে তুমি জান না।
লির ভেতর গাড়ি ঢোকে না
গলির ভেতর গাড়ি ঢোকে না।
শুভ্ৰ গাড়ি রেখে হেঁটে হেঁটে জাহেদের বাসার সামনে এল। জাহেদের বাসায় কোন কলিংবেল নেই। অনেকক্ষণ দরজার কড়া নাড়তে হয়। আজ কড়া নাড়তে হল না। বাড়ির বারান্দায় কাঠের চেয়ারে জাহেদ বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে। সে এখনো বাড় কাটিয়ে উঠতে পারে নি।
ঝড়ের সূত্রপাত হয় গত রাতে। বিয়ের পর রাত এগারোটার দিকে কেয়াকে নিয়ে ছোটমামার বাড়িতে এসে উঠল। তার আশা ছিল–নতুন বৌ, কেউ কিছু বলবে না। নিতান্ত হৃদয়হীন মানুষও নতুন বৌয়ের সামনে হৃদয়হীনতা দেখাবে না। তাছাড়া মিজান সাহেব হৃদয়হীন নন। হৃদয়হীন হলে দীর্ঘদিন জাহেদকে পুষতেন না।
কেয়াকে গাড়ি থেকে নামানোর পর মিজান সাহেব যে কাজটা করলেন, তাকে কোন রকম নিয়মের মধ্যে ফেলা যায় না। তিনি শীতল গলায় বললেন, জাহেদ, তোকে বউ নিয়ে এ বাড়িতে উঠতে নিষেধ করেছিলাম। তুই কি মনে করে উঠলি?
জাহেদ বলল, কাল চলে যাব, মামা।
কালের কথা তো হয় নি। তুই এখন যাবি। এই মুহুর্তে যাবি।
মনোয়ারা বললেন, আচ্ছা, তুমি চুপ কর তো। ও বউ নিয়ে ঘরে বসুক।
মিজান সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, শাট আপ। কোন কথা বললে খুন করে ফেলব। জাহেদ, তুই এক্ষুণি বউ নিয়ে বিদেয় হ। এক্ষুণি।
তিনি তাকাচ্ছেন অদ্ভূত ভঙ্গিতে। তাঁর চোখ লাল, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। তিনি থু করে একদলা থুথুও ফেললেন।
জাহেদ বলল, গাড়ি চলে গেছে, মামা। রাতও অনেক হয়েছে। বারোটার মত বাজে।
মিজান সাহেব হুংকার দিয়ে বললেন, গাড়ি ছাড়া তুই নড়তে পারিস না। কবে থেকে নবাব হয়েছিস? নবাবী কবে থেকে শিখেছিস? গাড়ি না থাকে রিকশায় যাবি। রিকশা না থাকলে হেঁটে যাবি। হারামজাদা কোথাকার!
মনোয়ারা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, কি হয়েছে তোমার! এরকম করছ কেন? ঘরে এসে বস তো। তিনি এসে স্বামীর হাত ধরলেন।
মিজান সাহেব ঝটিকা মেরে হাত সরিয়ে দিলেন। হুংকার দিয়ে বললেন–চুপ কর মাগী। তুই কোন কথা বলবি না। আমি তার সাথে বাহাস করছি না।
জাহেদ পুরোপুরি হকচাকিয়ে গেল। কেয়া অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। তার ভয়-ভয় করছে। এ কী ভয়ংকর অবস্থা! জাহেদ বলল, কেয়া, তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি একটা বেবীটেক্সি নিয়ে আসি।
মিজান সাহেব সহজ গলায় বললেন, দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? একটা চেয়ার এনে দে, বসুক। তুই গিয়ে বেবীটেক্সি নিয়ে আয়।
কেয়া বারান্দায় কাঠের চেয়ারে জড়সড় হয়ে বসে রইল। জাহেদ গোল বেবীটেক্সি আনতে। এই অবস্থা হবে জানলে শুভ্রের মাইক্রোবাসটা রেখে দিত। কেয়াকে নিয়ে সে এতরাতে যাবে কোথায় বুঝতে পারছে না। কোন একটা হোটেলে নিয়ে তুলবে? তুললেও মোটামুটি ভাল হোটেলে তুলতে হবে। ভাল হোটেলগুলি কোথায়? ভাড়াইবা কত?
আপার বাসায় যাওয়া যাবে না। আপা বিয়েতে আসে নি। জাহেদ শুভ্রের মাইক্রোবাস নিয়ে তাদের আনতে গিয়েছিল–সে চোখ-মুখ-লাল করে বলেছে, তুই আমাকে নিতে এসেছিস? তোর এত বড় সাহস? তুই তোর দুলাভাইকে বলে গেছিস–আমি তোর গলার হার চুরি করেছি। তারপরেও আমাকে নিতে এসেছিস।
জাহেদ বলল, আমি তো এমন কথা কখনো বলিনি, আপা?
তাহলে তার দুলাভাই মিথ্যা কথা বলছে? আমি হলাম চোর, আর তার দুলাভাই মিথ্যাবাদী? বের হ বাড়ি থেকে। বের হ বললাম।
বেবীটেক্সিতে উঠার সময় কেয়া বলল, কোথায় যাবে কিছু ঠিক করেছ? জাহেদ অস্পষ্ট একটা শব্দ করল। কেয়া ক্লান্ত গলায় বলল, আমাকে বড় আপার বাসাতেই রেখে এসো। পরে একটা কোন ব্যবস্থা হবে। প্রচন্ড মাথা ধরেছে।
জাহেদ বলল, আচ্ছা।
জাহেদ জড়সড় হয়ে বসে আছে। কেয়া হাত বাড়িয়ে জাহেদের হাত ধরল। কোন কথা বলল না। জাহেদ বলল, কেয়া, আমি খুব লজ্জিত।