শুভ্ৰ সহজভাবে বলল, তোমার কত টাকা আছে, বাবা?
চট করে বলতে পারব না। তবে আমাকে দেখে বা আমার জীবনযাপন পদ্ধতি দেখে আমার অর্থ-বিত্ত সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব না। আমি খুব লো প্রোফাইল মেইনটেইন করি।
তুমি বলতে চাচ্ছি। তোমার প্রচুর টাকা?
হ্যাঁ।
টাকা তোমার কাছে কখনো ঝামেলা বলে মনে হয় নি?
টাকা ঝামেলা মনে হবে কেন? টাকার অভাবই ঝামেলা বলে মনে হয়েছে।
শুভ্ৰ কিছু বলতে গিয়েও বলল না। থেমে গেল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, তুমি কি কিছু বলতে চাচ্ছি?
না।
বলতে চাইলে বলতে পার। আমি তোমার সঙ্গে ফ্রি ডিসকাশন করতে চাই। দেখ শুভ্ৰ, আমি কঠোর পরিশ্রম করে টাকা করেছি। আমি মদ খাই না। জুয়া খেলি না। রিল্যাক্স করার জন্যে বিদেশের নাইট ক্লাবে যাই না। কঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলায় জীবনযাপন করেছি–কেন করেছি বলে তোমার ধারণা?
কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে করনি। তোমার স্বভাবই হচ্ছে এরকম। একেক মানুষ একেক রকম।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব বেশ কিছুক্ষণ দ্রু কঁচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন। হালকা গলায় বললেন, তোমার মা তোমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। ঐদিন কি এক মেয়ের কথা বললেন। বিয়ের ব্যাপারে তুমি কি কিছু ভাবছ?
না, কিছু ভাবছি না।
তোমার পছন্দের কেউ কি আছে? থাকলে বলতে পার।
শুভ্ৰ হাসল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মতি মিয়া অপেক্ষা করছিল–টি কোজি ঢাকা চায়ের পট নিয়ে ঢুকল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব ডিনারের পর পর হালকা লিকারে এক কাপ চা খান। শুভ্র বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার হাত ধোয় হলে সে হাত ধুবো। শুভ্র বলল, তোমাকে একটা কথা বলা বোধহয় দরকার, বাবা, আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চাই। আমার টাকাপয়সার দরকার নেই।
আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। তুমি কি এ বাড়িতে অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছ?
শুভ্ৰ চুপ করে রইল। ইয়াজউদ্দিন তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, তোমার কি ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনা আছে?
হ্যাঁ আছে।
আমি কি জানতে পারি?
অন্য আরেকদিন বলব, বাবা।
আজ বলতে সমস্যা কি?
আজ তুমি আমার কথা মন দিয়ে শুনবে না। যে কোন কারণেই হাক আজ তুমি উত্তেজিত।
এসো চা খাই।
দুজন নিঃশব্দে চায়ের পেয়ালা হাতে বসল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব কোন একটা মজার কথা বলতে চাচ্ছেন। হালকা কোন রসিকতা। এনেকডোটস। চায়ার টেবিলে এই কাজটা তিনি প্রায়ই করেন। আশ্চর্য! কোন রসিকতা মনে পড়ছে না। তিনি আসলেই উত্তেজিত।
মতি! মতি মিয়া!
মতি এসে দাঁড়াল। মতিকে কি জন্যে ডেকেছেন ইয়াজউদ্দিন সাহেব মনে করতে পারলেন না।
কটা বাজে মতি?
মতি বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছে। প্রশ্নটা অর্থহীন। ইয়াজউদ্দিন সাহেবের হাতে ঘড়ি আছে, দেয়ালে ঘড়ি। এ বাড়ির এমন কোন ঘর নেই। যেখানে দেয়ালে ঘড়ি টিক টিক করছে না।
স্যার, এগারোটা বাজে।
আচ্ছা যাও।
শুভ্ৰ বলল, বাবা, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? তুমি ঘামছ।
শরীর খারাপ লাগছে না। গরম লাগছে। তুমি কি আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ বারান্দায় বসবে?
অবশ্যই বসব।
অনেকদিন তোমার সঙ্গে কথা হয় না। আমি নিজে ব্যস্ত থাকি, তুমিও সম্ভবত ব্যস্ত থাক।
আমি তো ব্যস্ত থাকি না। আমার আসলে কিছুই করার নেই।
আমি শুনেছি। সারাদিন তুমি বাসায় থাক না। কি করা?
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, বাবা।
কেন?
কারণ নেই কোন। এম্নি।
কলাবাগানের এক বাসায় তুমি যাও। প্রায়ই যাও। কার বাসা?
শুভ্র সহজ গলায় বলল, তুমি কি করে জানলে বাবা?
ইয়াজউদ্দিন খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, আমাকে খোঁজ-খবর রাখতে হয়। তুমি পৃথিবী সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। যে কোন সময় ঝামেলায় পড়তে পার। বাবা হিসেবে এইটুকু সাবধানতা নেয়া অন্যায় নয় নিশ্চয়ই।
ন্যায়-অন্যায়ের কথা বলছি না। আমার মজা লাগছে তাই জিজ্ঞেস করছি।
তুমি কোথায় যাও না যাও সে সম্পর্কে একটা রিপোর্ট দেবার জন্যে আমি একজনকে বলেছিলাম। সে রিপোট দিয়েছে। পড়তে চাও?
না।
কলাবাগানে তুমি যে বাসায় যাও সেটা কার বাসা?
রিপোটে কি লেখা নেই?
লেখা আছে। তবু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
সাবেরের বাসা। সাবের কলেজে আমার সঙ্গে পড়তে। আই.এ. পাশ করার পর মারা যায়। আমি ঐ বাসায় যাই সাবেরের বাবার সঙ্গে গল্প করার জন্যে। উনার নাম মাহিন। উনার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভাল লাগে।
ভদ্রলোক কি করেন?
স্কুল মাস্টার ছিলেন। এখন অবসর নিয়েছেন। ঘরেই থাকেন।
শুভ্ৰ, তুমি খোলাখুলি সবকিছু আমাকে বলছ না। ভদ্রলোক প্যারালিসিস হয়ে দীর্ঘদিন বিছানায় পড়ে আছেন। এই খবর আমার কাছে আছে।
এই তথ্যটা অপ্রয়োজনীয় বাবা।
কোন তথ্যই অপ্রয়োজনীয় নয়। ঐ বাসায় মাহিন সাহেব ছাড়া আর কে থাকে?
তোমার রিপোটে কি লেখা নেই?
হ্যাঁ আছে। তারপরও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
শুভ্ৰ বলল, তুমি বলছিলে বারান্দায় বসবে। চল বারান্দায় বসি। ইয়াজউদ্দিন সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, মাহিন সাহেবের মেয়েটির প্রতি কি তোমার কোন দুর্বলতা আছে? এই ব্যাপারটা আমি তোমার কাছে থেকে খোলাখুলি জানতে চাই।
আমি মাহিন সাহেবের সঙ্গে গল্প করার জন্যেই যাই। নীতু আপার সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয় না বললেই চলে।
তুমি মেয়েটিকে আপা ডাক?
হ্যাঁ। উনি সাবেরের তিন বছরের বড়।
তারা দুজন বারান্দায় এসে বসল। শুভ্র বলল, তুমি কি আর কিছু বলবে, বাবা?
হ্যাঁ, বলব। তুমি বছর খানিকের জন্যে দেশের বাইরে থেকে ঘুরে আস। তোমাকে এক বছরের ছুটি দেয়া হল। ফিরে এসে আমার সব দায়দায়িত্ব তুমি নেবে। একা একা ঘুরে বেড়ানার মত অবস্থা তোমার না। আমার ধারণা, তুমি একা একা চিটাগাং থেকে ঢাকাও যেতে পারবে না। কাজেই তোমাকে একজন সফর সঙ্গি দেবার ব্যবস্থা করব। বিয়ে করে বৌ নিয়ে যাবে।