- বইয়ের নামঃ মেঘের ছায়া
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
গ্লাসভর্তি তেতুলের সরবত
রেহানা গ্লাসভর্তি তেতুলের সরবত নিয়ে যাচ্ছিলেন, শুভ্রর ঘরের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন। চাপা হাসির শব্দ আসছে। শুভ্ৰ হাসছে। রাত একটা বাজে। শুভ্রের ঘরের বাতি নেভানো। সে অন্ধকারে হাসছে কেন? মানুষ কখনো অন্ধকারে হাসে না। কাঁদতে হয় অন্ধকারে, হাসতে হয় আলোয়। রেহানা ডাকলেন, শুভ্ৰ।
শুভ্ৰ হাসি থামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, কি মা?
কি করছিস?
ঘুমুচ্ছিলাম, হঠাৎ ঘুম ভাঙল। রাত কত মা?
একটা বাজে। তোর কি কিছু লাগবে?
না।
শুভ্র আবার হাসছে। শব্দ করে হাসছে।
রেহানা চিন্তিত মুখে সরবতের গ্লাস নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন। কেন জানি শুভ্রকে নিয়ে তঁর চিন্তা লাগছে। তাঁর মনে হচ্ছে শুভ্রর কোন সমস্যা হয়েছে।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব খালি গায়ে ফ্যানের নিচে বসে আছেন। কার্তিক মাস, ঠাণ্ড-ঠাণ্ডা লাগছে। শীত নেমে গেছে। ঘুমুতে হয় পাতলা চাদর দিয়ে। এই সময়ে খালি গায়ে ফ্যানের নিচে বসে থাকার অর্থ হয় নীল। ইয়াজউদ্দিন সাহেব বসে আছেন, কারণ তাঁর গরম লাগছে। অল্প-অল্প ঘাম হচ্ছে। বুকে চাপা ব্যথা অনুভব করছেন। তাঁর ধারণা, তিনি হার্ট এ্যাটাক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। অন্য যে-কেউ এই অবস্থায় ঘাবড়ো যেত। ইয়াজউদ্দিন সাহেব খুব স্বাভাবিক আছেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গ্ৰললেন, গ্লাসে কি?
তেতুলের সরবত। বিট লবণ, চিনি, তেতুল। খাও, ভাল লাগবে।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব কোন তর্কের ভেতর গেলেন. না। গ্লাস হাতে নিলেন। রেহানার নিবুদ্ধিতায় মাঝে মাঝে তিনি পীড়িত বোধ করেন। আজও করছেন। তাঁর কি সমস্যা রেহানা জানে না। রেহানাকে বলা হয় নি। অথচ সে তেতুলের সরবত নিয়ে এসেছে, এবং রেহানার ধারণা হয়েছে এই সরবত খেলে ইয়াজউদ্দিন সাহেবের ভাল লাগবে। কে তঁকে এই সব চিকিৎসা শিখিয়েছে? বছর দুই আগে তাঁর একবার তীব্ৰ পেটব্যথা শুরু হল। রেহানা এক গ্লাস বরফ-শীতল পানি নিয়ে এসে উপস্থিত, পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল, পানিটা খাও, ভাল লাগবে। তিনি খেয়েছেন। আজও তাই করলেন, হাত বাড়িয়ে তেতুলের সরবত নিয়ে দু’চুমুক খেয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখলেন। রেহানা বললেন, ভাল লাগছে না?
হ্যাঁ, ভাল লাগছে।
চিনি কম হয়েছে, আরেকটু চিনি দেব?
চিনি ঠিকই আছে।
শরীরটা কি এখন ভাল লাগছে?
হ্যাঁ, ভাল লাগছে। ফ্যান একটু বাড়িয়ে দাও।
ইয়াজউদ্দিন সাহেবের শরীর মোটেই ভাল লাগছে না। নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে। বসে থেকে স্বস্তি পাচ্ছেন না। শুয়ে পড়লে হয়ত ভাল লাগত। তিনি ঘড়ি দেখলেন, একটা দশ বাজে। ঘরে আলো জ্বলছে। আলো চোখে লাগছে। মানুষের অসুস্থতার প্রথম লক্ষণ হচ্ছে–আলো অসহ্য বোধ হওয়া। অসুস্থত মানুষকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যেতে চায়।
রেহানা বললেন, তুমি কি বারান্দায় এসে বসবে? বারান্দায় হাওয়া আছে। হাওয়ায় বসলে তোমার ভাল লাগবে।
চল বারান্দায় যাই।
সরবতটা খাবে না?
না।
ইয়াজউদ্দিন স্ত্রীর সাহায্য ছাড়াই উঠে দাঁড়ালেন। বারান্দায় গিয়ে বসলেন। পুরানো ধরনের এই বাড়ির পেছনে লম্বা টানা বুল-বারান্দা। বারান্দার এক মাথায় তিনটি বেতের চেয়ার ছাড়া কোন আসবাব নেই। চেয়ার তিনটি দেয়াল ঘেঁসে। পাশাপাশি সাজানো। সাদা রঙ করা, গদি সবুজ। মাঝখানের চেয়ারটা তাঁর। দীর্ঘ দশ বছরে তিনি কখনো মাঝের চেয়ার ছাড়া কোথাও বসেননি। আজ বসলেন। তিনি সর্ব দক্ষিণের চেয়ারে বসেছেন। মাঝেরটা খালি। তিনি ভেবেছিলেন, রেহানা এই ব্যাপারটা ধরতে পারবে। সে মনে হচ্ছে ধরতে পারেনি। রেহানা তাঁর পাশের চেয়ারেও বসেনি। মাঝখানে একটা খালি চেয়ার রেখে তৃতীয় চেয়ারটিতে বসেছে।
রেহানা।
হুঁ।
শুভ্ৰ-র ঘরে বাতি জ্বলছে কেন? ও-কি জেগে আছে?
হ্যাঁ, জেগে আছে।
এত রাত পর্যন্ত তো জেগে থাকার কথা না। আমার মনে হয় সে বাতি জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি একটু দেখে এসো তো।
রেহানা উঠে চলে গেলেন। খালিগায়ে বারান্দায় বসে থাকায় তীর একটু শীতশীত লাগছে। বুকের চাপ ব্যথা একটু কমেছে বলে মনে হচ্ছে। পানিতে গুলো একটা এ্যাসপিরিনের চার ভাগের এক ভাগ এবং ঘুমের জন্যে দুটা পাঁচ মিলিগ্রামের ফ্রিজিয়াম খেয়ে শুয়ে পড়লে হয়। যে কোন শারীরিক অসুস্থতায় গাঢ় ঘুম সাহায্য করে। শরীর তার নিজস্ব পদ্ধতিতে তার বিকল অংশ ঘুমের মধ্যে ঠিক করে ফেলে, কিংবা ঠিক করে ফেলার চেষ্টা করে। তিনি রেহানার জন্য অপেক্ষা করছেন। রেহানা ফিরছেন না। ইয়াজউদ্দিন সাহেব নিশ্চিত হলেন–শুভ্ৰ জেগে আছে, সে মার সঙ্গে গল্প করছে। তারা দুজন কি কথা বলছে ইয়াজউদ্দিন সাহেবের শোনার ইচ্ছা! করল। সেই ইচ্ছা স্থায়ী হল না। তঁর বয়স চুয়ান্ন। এই পৃথিবীতে তিনি যে দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছেন, তা বোধহয় বলা চলে। এই দীর্ঘ জীবনে তিনি অন্যায় এবং অনুচিত ইচ্ছাকে প্রশ্ৰয় দেন নি। মা এবং ছেলের গল্প আড়াল থেকে শোনার ইচ্ছা অবশ্যই অন্যায় ইচ্ছা।
শুভ্ৰ খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার কোলে শাদা রঙের বালিশ। শুভ্রের গায়ের ফুলহাতা শটটাও ধবধবে শাদা। শুভ্ৰ কনুই-এ ভর দিয়ে মার দিকে ঝুঁকে আছে। তার মাথাভর্তি এলোমেলো চুল। চোখে চশমা নেই বলে শুভ্রর বড় বড় কালো চোখ দেখা যাচ্ছে। রেহানা মনে মনে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার এই ছেলেটা এত সুন্দর হল কেন? ছেলেদের এত সুন্দর হতে নেই। শারীরিক সৌন্দর্য ছেলেদের মানায় না।