কী রে হাসান আমার মৃত্যু সংবাদ শুনেও তুই দেখতে এলি না। তুই এত বড় পাষণ্ড! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
দাদিমা আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি।
অসুখ হবে না–রোদের মধ্যে টো টো করে ঘোর। নিয়ম নাই, শৃঙ্খলা নাই। অসুখ হয়েছে ভালো হয়েছে।
আপনি এমন রেগে আছেন কেন দাদিমা?
জোয়ান ছেলে অসুখ বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে আছিস রাগব না? আমি খুবই রাগ করেছি। দরজা-জানালা বন্ধ করে পড়ে আছিস কেন? মরার আগেই তুই দেখি ঘরটাকে কবর বানিয়ে ফেলেছিস। জানালা খোল।
জানোলা খুলতে ইচ্ছা করে না দাদিমা।
ইচ্ছা না করলেও খুলতে হবে। দাঁড়া আমি খুলে দিচ্ছি।
আম্বিয়া খাতুন অনেক চেষ্টা করলেন। জানালা খুলতে পারলেন না। বৃদ্ধর প্রাণান্ত চেষ্টা দেখে হাসান নিজের মনে খুব হাসল। হাসান যতই হাসছে বৃদ্ধা ততই রাগছেন।
হাসানকে খুব অবাক করে দিয়ে হাসপাতালের কেবিনে উপস্থিত হলো চিত্ৰলেখা। তার উপস্থিতি কল্পনায় নয়, বাস্তবে। চিত্ৰলেখা আগের চেয়ে রোগা হয়েছে। গায়ের রঙও খানিক কমেছে। কিন্তু সে আরো সুন্দর হয়েছে।
চিত্ৰলেখা হাসিমুখে বলল, আপনার অসুখের খবর আমি অনেক আগেই পেয়েছি–আসতে দেরি করলাম।
এই প্রথম হাসান লক্ষ করল কেউ একজন হাসপাতালে তার সঙ্গে দেখা করতে এসে হেসে হেসে কথা বলছে। যেন হাসানের অসুস্থতা কোনো ব্যাপারই না।
দাড়িগোফ গজিয়ে একাকার করে ফেলেছেন। শেভ করেন না কেন?
রোজ করি না। দু-এক দিন পর পর করি।
রোজ শেভ করবেন। সকালবেলা শেভ করে আয়না দিয়ে চুল আঁচড়ে–আয়নার দিকে তাকিয়ে বলবেন, হ্যালো ইয়াংম্যান।
আচ্ছা বলব। আপনি আমাকে দেখতে আসবেন আমি ভাবি নি।
অন্যেরা ভাবতে পারে না–এমন সব কাণ্ডকারখানা আমি প্রায়ই করি। শুনুন হাসান সাহেব, আপনি বোধহয় জানেন যে আমি একজন ডাক্তার।
জ্বি জানি।
আপনার অসুখ সম্পর্কে যা খোঁজখবর নেবার আমি নিয়েছি। ডাক্তারদের ডায়াগনেসিস দেখেছি। ডায়াগনেসিস ভালো করেছেন। মনে হচ্ছে টিউমারটা শেকড় বসিয়ে দিয়েছে।
তার মানে কি এই যে আমার সময় শেষ?
হ্যাঁ, মানে মোটামুটি তাই। তবে শুনুন হাসান সাহেব–অপারেশন এবং রেডিওথেরাপির সুযোগ আছে। অপারেশনটা খুবই জটিল। তবে জনস হবকিন্সে দুজন সার্জন আছে যাঁদের হাত জাদুকরী হাত। তারপরেও রিকোভারির সম্ভাবনা কম। থাটি পার্সেন্ট। তবে থাটি পার্সেন্ট সম্ভাবনাও এক অর্থে অনেক সম্ভাবনা। তাই না।
জ্বি।
আমি সেই সম্ভাবনাটা যাচাই করতে চাই। আপনাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া এবং সম্ভাবনাটুকু পরীক্ষা করার আমার ইচ্ছা। আপত্তি আছে?
আপনি এটা করতে চাচ্ছেন কেন?
দুটা কারণ আছে। প্রথমটা আপনাকে বলা যাবে। দ্বিতীয়টা বলা যাবে না। প্রথম কারণ হলো, আমার বাবা আপনাকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি আমাকে বলে গিয়েছিলেন–আপনার কোনো সমস্যা হলে দেখতে।
ও আচ্ছা।
চিত্ৰলেখার দ্বিতীয় কারণটা অনেক জোরালো। হাসান নামের অতি দুর্বল এই মানুষটাকে হিশামুদিন সাহেবের চেয়েও অনেক বেশি পছন্দ তার নিজের। অহঙ্কারী মেয়েরা নিজের পছন্দের কথা সব সময় লুকিয়ে রাখে।
হাসান সাহেব।
জ্বি।
আমি যদি আপনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি আপনার আপত্তি আছে?
জ্বি না।
থ্যাংক য়্যু।
চিত্ৰলেখা হঠাৎ লক্ষ করল তার চোখে পানি চলে আসছে। সে জানালার কাছে সরে গেল। জানালা বন্ধ কেন? জানালা খুলে দি কেমন?
জ্বি আচ্ছা।
চিত্ৰলেখা জানালা খুলে দিয়েছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিশাল একটা মেঘের স্তুপ ভেসে ভেসে আসছে। খুব সাবধানে চিত্ৰলেখা তার চোখ মুছল। তার কাছে মনে হলো–মেঘের সঙ্গে মানুষের খুব মিল। মানুষ যেমন কাঁদে মেঘও কাঁদে। বৃষ্টি হচ্ছে মেঘের অশ্রু। চিত্ৰলেখা মুগ্ধ হয়ে মেঘের স্তুপের দিকে তাকিয়ে আছে।
লেখকরা কল্পনা করতে খুব ভালোবাসেন। আমার কল্পনা করতে ভালো লাগছে–হাসপাতালের জানালা থেকে যে মেঘটা দেখা যাচ্ছে সেই মেঘই এক সময় ঢেকে দিয়েছিল তিতলী এবং শওকতকে।
মানুষের কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিল খুব একটা হয় না। কল্পনা করতে ভালো লাগে। হাসানের অসুখ সেরে গেছে। সে শুরু করেছে আনন্দময় একটা জীবন। বুড়িগঙ্গায় নৌকায় করে ঘুরতে গিয়েছে। নদীতে খুব ঢেউ উঠেছে। চিত্ৰলেখা ভয় পেয়ে বলছে, এ কোথায় নিয়ে এলে? আমি তো সাঁতার জানি না। নৌকা এমন দুলছে কেন? নৌকার মাঝি হাসিমুখে বলছে, টাইট হইয়া বহেন আফা, আমি আছি কোনো চিন্তা নেই।
খুব সহজে কল্পনা করা যায়, তারেক ঘর গোছাতে গিয়ে হঠাৎ ড্রয়ারে খুঁজে পেয়েছে রীনার লেখা চিঠি-চিঠিটা খুব ছোট্ট। রীনা লিখেছে, ‘তুমি কোনোদিন জানবে না, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।’ চিঠি পড়েই তারেক বের হলো। যে করেই হোক রাগ ভাঙিয়ে রীনাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
বাস্তব কখনো গল্পের মতো হয় না। বাস্তবের রীনা ফিরে আসে না। বাস্তবের হাসানদের সঙ্গে কখনো বুড়িগঙ্গার জলের ওপর চিত্ৰলেখার দেখা হয় না। তবে বাস্তবেও সুন্দর সুন্দর কিছু ব্যাপার ঘটে। যেমন–লিটনের ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়। লিটন তার বন্ধু হাসানের পাঠানো দুটো নাম থেকে একটি নাম তার মেয়ের জন্যে রাখে। দুটি নামের কোনোটাই তার পছন্দ না–তিতলী, চিত্ৰলেখা। তারপরেও সে মৃত বন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্ৰদ্ধা জানাতে মেয়ের নাম রাখল–চিত্ৰলেখা।