হাসানকে রোজই একবার লায়লা দেখতে আসে। এই মেয়েটাকে হাসানের ভালো লাগে। লায়লা ঘরে ঢোকে কাদো কাদো মুখে।
ভাইয়া আজ তোমার অবস্থা কী? বলে বিছানায় বসে। কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মুখ থেকে কাদো কাদো ভাবটা চলে যায়। সে মনের আনন্দে তার সংসারের গল্প শুরু করে। গল্প করার সময় আনন্দে সে কলমল করতে থাকে। হাসানের সব সময় মনে হয় এই আনন্দের পাশে দীর্ঘ সময় থাকলে তার মাথার অসুখটা কমে যাবে।
ভাইয়া শোন-বাবু কী রকম যে দুষ্ট তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না। ওর বাবার অবশ্য ধারণা আগে এত দুষ্ট ছিল না। আমি নাকি লাই দিয়ে দিয়ে তাকে দুন্টু বানাচ্ছি। এত ছোট একটা বাচ্চা আমি তো আদর করবই। মুখে ভাত তুলে না দিলে সে খায় না। বেচারা ছেলেমানুষ না। ও কী বলে জান? ও বলে রাত্ৰি তুমি বাবুকে যতটা ভালবাস আমাকে তার দশ ভাগের এক ভাগও বাস না। বুঝলে ভাইয়া ও আমাকে লায়লা ডাকে না। লায়লার অর্থ রাত। সেই জন্যে ডাকে রাত্রি। লজার ব্যাপার না? এখন কী করব। বল? আদর করে ডাকে আমি তো না বলতে পারি না। পরশুদিন আবার বলল, চল সিঙ্গাপুর থেকে ঘুরে আসি। ছেলের স্কুল কামাই করে আমি সিঙ্গাপুর যাব। আমার এত শখ নেই। ও তা শুনবে না। ওর স্বভাব হচ্ছে একবার কোনো একটা কথা মুখ দিয়ে বলে ফেললে সেটা করতেই হবে। খুব ভয়ে ভয়ে আছি। এদিকে আমার ড্রাইভার কী করেছে। জান? গত মঙ্গলবারের কথা। আমাকে বলল, চাকা পাংচার হয়েছে ঠিক করতে হবে। আমি একশ টাকা দিলাম। সে আর টাকা ফেরত দেয় না। বৃহস্পতিবার তাকে ডেকে বললাম। চাকা পাংচার সারাই করতে কুড়ি টাকা লাগে। বাকি আশি টাকা কোথায়? সে বলল, ম্যাডাম পকেটমার হয়ে গেছে। ওই আশি টাকা তো গেছেই আমার নিজেরও দু শ টাকা গেছে। এখন সে এডভান্স বেতন চায়। আমার অবস্থা দেখেছ?
তোর তো কঠিন অবস্থা।
কঠিন অবস্থা তো বটেই। কাউকে যে তুমি বিশ্বাস করবে। সে উপায় নেই। সবার দিকে চোখ রাখতে হয়। আমি তো আর মাছি না যে আমার পঞ্চাশ হাজার চোখ আছে। আমি একা কদিক সামলাব?
তা তো ঠিক।
সন্ধ্যা হতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমোতে পারি না। ওর অভ্যাস হচ্ছে রাতে ছবি দেখা। আমাদের একটা LD প্লেয়ার আছে। LD নিয়ে আসে। রোজ ছবি দেখে। LD কী জানি ভাইয়া?
না।
LD হলো লেজার ডিস্ক। পুরো সিনেমাটা একটা গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো রেকর্ডে থাকে। কী সুন্দর ছবি যে আসে না দেখলে তোমার বিশ্বাস হবে না। একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে দেখাব। সরি বাসা বলে ফেলাম। বলা উচিত ছিল বাড়ি। বাসা তো না, আমরা তো আর ভাড়া বাড়িতে থাকি না যে বাসা। তাই না ভাইয়া? তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?
না চোখ বন্ধ করে আছি।
ঠিক আছে তুমি রেস্ট নাও। আর শোন ভাইয়া, বেশি চিন্তা করবে না। আমি রোজ এসে দেখে যাব। ও বলছিল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করাতে। মাঝে মাঝে হোমিওপ্যাথি মিরাকলের মতো কাজ করে। ওর এক আত্মীয়ের তোমার মতো ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছিল। ডাক্তাররা সব জবাব দিয়ে দিয়েছে। তখন সে হোমিওপ্যাথি শুরু করে আস্তে আস্তে টিউমার মিলিয়ে যায়। যে ডাক্তার ওষুধ দিয়েছিলেন তিনি আবার ইন্ডিয়া চলে গেলেন। আমি ওকে বলেছি–ইন্ডিয়াতেই যাক আর বিলাতেই যাক তুমি সেই ডাক্তারের খোঁজ বের করবে।
দেখ খুঁজে।
ভাইয়া আজ যাই।
আচ্ছা।
হাসানের অসুখের খবর সে কাউকে দেয় নি। তারপরেও কেমন করে জানি সবাই জেনে গেছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ উপস্থিত হচ্ছে। হাসানকে বিস্মিত করে একদিন সুমি এসে উপস্থিত। তার গায়ে ধবধবে সাদা ফ্রক। হাতে অনেকগুলো গোলাপ। কী সুন্দরই না হয়েছে মেয়েটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
স্যার কেমন আছেন?
ভালো।
আপনাকে দেখতে এসেছি।
থ্যাংক য়্যু। খবর পেলে কোথায়?
সুমি মুখ টিপে হেসেছে। খবর কোথায় পেয়েছে সে বলবে না।
এত বড় অসুখ কী করে বাঁধালেন?
বুঝতে পারছি না। সুমি। অসুখের কথা থাক। তুমি কেমন আছ বল?
ভালো আছি।
তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ?
হুঁ।
তোমার যে ই.এস.পি, ক্ষমতা ছিল এখনো কি আছে? ভবিষ্যৎ বলতে পারতে। এখনো কি পার?
হুঁ।
আচ্ছা বল দেখি আমি আর কত দিন বাঁচব?
সুমি হাতের ফুলগুলো নাড়াচাড়া করছে। কিছু বলছে না। কিন্তু তার মুখ বিষন্ন নয়।
স্যার আপনার জন্যে একটা মজার জিনিস। এনেছি।
মাজার জিনিসটা কী?
এক ধরনের ক্যান্ডি। মুখে দিয়ে রাখবেন–এক সময় মুখের ভেতর পটপট শব্দ হতে থাকবে।
সে কী?
বাবা বাইরে থেকে নিয়ে এসেছেন। মুখে দিয়ে দেখুন।
হাসান ক্যান্ডি মুখে দিয়েছে। এক সময় মুখের ভেতর সত্যি সত্যি পটপট শব্দ হওয়া শুরু করল। হাসান থুঁ করে ক্যান্ডি ফেলে দিল। সুমি হাসছে খিলখিল করে। হাসান মুগ্ধ হয়ে হাসির শব্দ শুনছে।
শীতের মাঝামাঝি সময়ে হাসানের অবস্থা খুব খারাপ হলো। তাকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। হাসপাতালটাই হয়ে গেল তার ঘরবাড়ি। কেবিনে স্যাতস্যাতে ঘর। বিবৰ্ণ দেয়াল। ফেনাইলের গন্ধমাখা মেঝেতে তার জীবন আটকে গেল। মানুষের সঙ্গ তার অসহ্য বোধ হতে শুরু করল। কেবিনের জানালা খুলে আকাশ দেখতে তার ভালো লাগে না। তার ভালো লাগে কুণ্ডলী পাকিয়ে নিজেকে ছোট্ট করে শুয়ে থাকতে। নিজের মনে কথা বলতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে নিজের মনে কথা বলে। একেক সময় একেকজন এসে তার মাথায় উপস্থিত হয়। এদিন যেমন এলেন আম্বিয়া খাতুন।