তিতলী শওকতের গায়ে হাত রেখে কোমল স্বরে ডাকল–এই ওঠ তো। ওঠ।
শওকত চোখ মেলল। অদ্ভুত একটা দৃশ্য সে দেখছে—তিতলী তার গা ঘেঁসে বসে আছে। তিতলীর একটা হাত তার পিঠে। এটি কি কোনো স্বপ্নদৃশ্য? না স্বপ্নদৃশ্য নয়। তিতলীর গা থেকে বাসি ফুলের গন্ধ আসছে। স্বপ্নদৃশ্যে গন্ধ থাকে না।
চট করে উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাও।
কেন?
বাইরে যে কী সুন্দর! আমি এতক্ষণ মেঘের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিলাম।
সত্যি।
হ্যাঁ সত্যি। এই দেখ তোমার গা ছুঁয়ে বলছি। শুয়ে আছ কেন ওঠ।
শওকত হাত বাড়িয়ে তিতলীর হাত ধরল। তিতলী হাত সরিয়ে নিল না। শওকত তাকে কাছে টানল। তিতলী কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে রইল–তারপর হঠাৎ নিজেকে ছেড়ে দিল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কী করছ দরজা খোলা! শওকত বলল, থাকুক খোলা।
তিতলী বলল, তোমার গায়ে জ্বর নেই?
না নেই।
তিতলী বলল, আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। তুমি কি এক সেকেন্ডের জন্য আমাকে ছাড়বে?
এক সেকেন্ডে কী করবে?
দরজা লাগিয়ে দেব।
দরজা লাগাতে হবে না।
কী আশ্চর্য বারান্দা দিয়ে বেয়ারারা আসা-যাওয়া করছে।
ওরা হাইলি টেন্ড। হোটেলের খোলা দরজা দিয়ে এরা কখনো ভেতরে তাকাবে না।
আমরা হিমালয় দেখব না?
হিমালয় পালিয়ে যাচ্ছে না।
আমিও তো পালিয়ে যাচ্ছি না। ছিঃ ছিঃ তুমি তো আমাকে নগ্ন করে ফেলছ। আমি কিন্তু এখন ধাক্কা দিয়ে তোমাকে বিছানা থেকে ফেলে দেব।
ফেলে দাও।
ধাক্কা দিতে গিয়ে তিতলী ধাক্কা দিতে পারল না। তার শরীর জেগে উঠেছে। সে গভীর মমতা ও ভালবাসায় শওকতকে জড়িয়ে ধরল। হিমালয় সূর্যকিরণ মেখে তার রঙ বদলাচ্ছে। ফেরারি মেঘমালার দু-একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে হোটেলের চারপাশে। তিতলীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে কোনো একটা দুষ্ট প্রকৃতির মেঘ বোধহয় খোলা দরজা দিয়ে তাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। তারা ডুবে গেছে মেঘের দিঘিতে।
তারেক অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে
তারেক অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে। কোনো কথাটথা না। চুপচাপ বসে থাকা।
হাসান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার বিছানার চাদরটা ধবধবে সাদা। গায়ে যে চাদরটা আছে তার রঙও সাদা। সে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। বাইরে বেশ গরম। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। কিন্তু হাসানের মনে হয় শীত লাগছে।
তারেক বলল, তোর মাথার যন্ত্রণা কি একটু কমেছে?
হাসান নিচু গলায় বলল, হুঁ।
হুঁ বলার ধরন থেকেই বোঝা যায় মাথার যন্ত্রণা আসলে কমেনি। কড়া পেইনকিলার ব্যথাটাকে ভোঁতা করে দিয়েছে।
তুই যে এত বড় অসুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতি বুঝতেই পারি নি। আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে।
অসুখ-বিসুখ তো পৃথিবীতে আছেই।
তাও ঠিক।
তারেক আবার চুপ করে গেল। হাসান বলল, শুধু শুধু বসে আছ কেন? চলে যাও।
কোথায় যাব?
তোমার ঘরে যাও। অফিস থেকে এসেছ বিশ্রাম কর।
তোর কি কিছু খেতেটেতে ইচ্ছা করে?
না।
খেতে ইচ্ছে হলে বল। লজ্জা করবি না।
হাসান হাসল। একবার ভাবল বলে, আঙুর খেতে ইচ্ছে করছে। আঙুর নিয়ে এসো। বলা ঠিক হবে না। ভাইজান সত্যি আধকেজি আঙুর নিয়ে আসবে।
হাসান!
জ্বি ভাইজান।
আমার মনটা খুবই খারাপ হয়েছে।
তুমি ঘরে যাও তো। ঘরে গিয়ে বিশ্রাম কর।
আমার যদি ক্ষমতা থাকত–অবশ্যই তোকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করতাম। ঘরবাড়ি জমিজমা থাকলে অবশ্যই বিক্রি করতাম। কিছুই নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ডে ষোল সতের হাজার টাকা আছে। আমি অবশ্য হাল ছাড়ি নি। দেখি কী করা যায়। লায়লার স্বামীর কাছে টাকা ধার চাইব?
কারো কাছে কিছু চাইতে হবে না।
সে তো বাইরের কেউ না। এখন তো আমাদেরই একজন। টাকা তো আমি মেরেও দিচ্ছি না। মাসে মাসে শোধ দেব। মাসে তিন হাজার টাকা করে শোধ দিলেও বছরে হয়।
ভাইজান আমার আঙুর খেতে ইচ্ছে করছে।
কোনো ব্যাপারই না। এনে দিচ্ছি। কোনটা খাবি–সাদাটা না কালোটা? আচ্ছা! যা দু পদেরই আনিব। ভিটামিন সি ছাড়া আঙুরের অবশ্য ফুটভ্যালু কিছু নেই। তোর যখন খেতে ইচ্ছে করছে খা।
তারেক উঠে দাঁড়াল। হাসান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কেউ একজন পাশে এসে বসলেই তার খারাপ লাগে। পুরোপুরি এক সময়টা কাটাতে পারলে ভালো লাগত। কেউ কাছে আসবে না। চিঠি লিখবো। সেই চিঠিগুলো থাকবে বালিশের নিচে। যখন মাথার যন্ত্রণা একটু কমবে তখন সে চিঠি খুলে পড়বে। মানুষের সঙ্গের চেয়ে তাদের চিঠি পড়াটা এখন বোধহয় আনন্দময় হবে।
লিটনের একটা চিঠি পরশুদিন পেয়েছে। চিঠিটা বালিশের নিচে ছিল। আজ সকালে পড়েছে। কয়েকদিন পর হয়তো আবারো পড়বে। লিটন লিখেছে–
হাসান,
তোকে চিঠি লিখতে অনেক দেরি করে ফেললাম। আসলে কী ব্যস্ততায় যে সময় কাটছে। আমাকে না দেখলে তুই আমার ব্যস্ততা বুঝতে পারবি না। আমি ভোর আটটায় চলে যাই। ফিরি সন্ধ্যার পর। গ্রোসারি করা, ঘর-সংসার দেখা, রান্না করা–সব তোর ভাবির একা করতে হয়। সেই বেচারিরও নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমাদের এপাটমেন্টটা উনত্রিশ তলায়। আর লড্রিঘর হচ্ছে এক তলায়। কাপড় ধুতে হলেও নিচে নামতে হয়। এত উঁচুতে থাকতে শুরুতে খুব অস্বস্তি লাগত। মনে হত জোরে বাতাস এলেই বিল্ডিংটা বুঝি ভেঙে পড়বে। এখন অবশ্য সয়ে গেছে।
শম্পা সারাদিন কী করে জানিস ‘ শুধু ঘর গোছায়। রাজ্যের জিনিস কিনে ঘর ভর্তি করে ফেলেছে। তার যে এমন খরুচে হাত তা জানতাম না। তার শখের জিনিস কী জানিস–স্ট্রফড এনিমেল। ঘরটিকে সে একটা চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলেছে। আমি একদিন তার ওপর সামান্য রাগই করলাম।—সে কেঁদেকেটে একটা কাণ্ড করেছে। তার অভিমান ভাঙবার জন্যে শেষে আমি নিজেই একটা বিশাল হাতি কিনে দিয়েছি। দাম কত নিয়েছে। শুনলে তুই ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবি সাত শ’ সিঙ্গাপুরি ডলার। শম্পার সঙ্গে থেকে থেকে আমারও খরচে হাত হয়ে যাচ্ছে। এক সময় কী যে কষ্ট করেছি। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। আমার খুব ইচ্ছা তোকে এনে কিছু দিন আমাদের সংসারে রাখি। আরেকটু গুছিয়ে বসেই তোর জন্যে টিকিট পাঠাব।
ইতি লিটন
পুনশ্চ : হাসান তুই কি একটা কাজ করবি? খুব সুন্দর কিছু বাংলা নাম পাঠবি? কুড়িটা ছেলের নাম এবং কুড়িটা মেয়ের নাম। কী জন্যে নাম পাঠাতে বলছি বুঝতেই পারছিস। বিদেশে শিশুপালন খুবই যন্ত্রণা হবে। কী আর করা। আমরা খুবই খুশি। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।