এত অন্ধকার কেন ?
নেপালি ড্রাইভার বাংলা বাক্য বুঝল। জবাব দিল ইং – নো ইলেকট্রিসিটি । পাওয়ার ফেইলিউর ।
অন্ধকারে এতক্ষণ চোখে পড়ে নি- এখন দেখা যাচ্ছে- দক্ষিণে বিশাল দোতলা হোটেল। ভূতের বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে। ইলেকট্রিসিটি না থাকলে এত বড় হোটেলে চার্জলাইট জ্বলবে, বাতি জ্বলবে–পুরোপুরি অন্ধকার খাঁখাঁ করছে। বৃষ্টি সূচের মতো গায়ে বিধছে। তিতালীর শরীর কাঁপছে। এত ঠাণ্ডা বৃষ্টি এর আগে তার গায়ে পড়ে নি। পাহাড়ি বৃষ্টি কি এত ঠাণ্ডা হয়? বৃষ্টির এই নমুনা জানলে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই লিখতেন না, এস কর স্নান নবধারা জলে।
তিতালী হোটেলের লবিতে পা দেয়ামাত্র ইলেকট্রিসিটি চলে এল। চারদিক ঝলমল করে উঠল। হোটেল দেখে তিতালী মুগ্ধ। শোবার ঘরগুলো বড় বড়। ঘরে কাঠের পুরনো ধরনের আসবাব। ডেসিং টেবিলের আয়নাটা সুন্দর। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে । হোটেলের আয়না। সচরাচর ভালো হয় না। বাথরুমেও ঝক ঝক করছে ।
তিতলী খুশি খুশি গলায় বলল, হোটেলটা তো খুব সুন্দর।
শওকত বলল, হোটেলটা খুব সুন্দর না। মাঝারি ধরনের। তুমি কখনো ভালো হোটেলে থাক নি বলে তোমার কাছে এত সুন্দর লাগছে। তোমার কি ক্ষিধে লাগছে?
হুঁ।
তাহলে তুমি এক কাজ কর খেয়ে এস। ডাইনিং হলে চলে যাও। রাত বেশি হলে ডিনার পাবে না।
তুমি খাবে না?
আমার দাঁতের যে অবস্থা! পানি ছাড়া কিছু খেতে পারব না। তাছাড়া খেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে জ্বর আসছে। আমি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকব।
আমি একা একা খেতে যাব?
হ্যাঁ যাবে। আমরা যে বিচিত্র জীবন শুরু করেছি। সেখানে দোকার ব্যাপার তো নেই–তাই না? এক কাজ করা–ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নাও কিংবা গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর খেতে যাও। মেনু দেখে দেখে অর্ডার দেবে সমস্যা কিছু নেই। পারবে না?
পারব।
গুড।
শওকত বিছানায় গা এলিয়ে দিল। শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে। গা কেমন ঘিনীঘিন করছে। বাসি কাপড় ছাড়া হয় নি। ছাড়ার উপায়ও নেই। একসেট কাপড় হলেও কেনা দরকার ছিল। গরম পানিতে গোসল সেরে হোটেলের গামছা গায়ে জুড়িয়ে শুয়ে থাকলে হয়। ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে একজন তরুণীর সামনে ব্যাপারটা শোভন হবে না। এই তরুণী তার স্ত্রী এটিও খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। ভিক্টোরিয়ান যুগের গল্প-উপন্যাসে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন স্বামী-স্ত্রী হয়তো থাকে। এ যুগে কি থাকে? তিতলী যা করছে তা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা থেকে করছে। আর সে নিজে যা করছে তাও কি অসুস্থতা নয়? অন্যের অসুখকে প্রশ্রয় দেয়াও তো এক ধরনের অসুখ। সে যা ভেবেছিল তা হচ্ছে না–সময়ের সঙ্গে তিতলী সহজ হচ্ছে না। বরং উল্টোটা হচ্ছেঅস্বাভাবিক সম্পর্কই এখন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এক সময় আরো স্বাভাবিক মনে হবে। ভুল হচ্ছে, মস্ত বড় ভুল। ভুলের ছোট্ট চারা রোপণ করা হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই চারা ডালপালা মেলে মহীরুহ হয়ে গেছে। এই মহীরুহ এখন আর খুব সহজে টান দিয়ে উপড়ে ফেলা যাবে না। বড় করাত দিয়ে গাছটা কাটতে হবে। সেই করাত দুজনের করাত। করাতের এক মাথা থাকবে তার হাতে অন্য মাথা থাকবে তিতলীর হাতে। তিতলী কি সেই করাতের একমাথা ধরবে? মনে হয় না।
শওকতের জ্বর বাড়ছে। মনে হচ্ছে এন্টিবায়োটিকগুলো কাজ করছে না। ঠাণ্ডাও বোধহয় লেগেছে–বুকের ভেতর ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। সামান্য কাশি। নিউমোনিয়া না তো? বড় ধরনের অসুখ বাঁধিয়ে ফেললে তিতলী সমস্যায় পড়বে। বিদেশে অসুস্থ মানুষ মানে নানান যন্ত্রণা। তিতলী নামের এই মেয়েটিকে এ জাতীয় যন্ত্রণায় ফেলার কোনো অর্থ হয় না। মেয়েটা কে? কেউ না। খুব রূপবতী একটা মেয়ে যে বাস করছে ভয়ঙ্কর এক ঘোরের জগতে। ঘোর কাটছে না। সম্ভবত কাটবেও না।
তিতলী?
হুঁ।
ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দিতে বল। পানি খাব।
কাকে বলব? রুম সার্ভিসকে বলতে হবে। আচ্ছা টেলিফোনটা আমার কাছে দাও–আমি বলছি। তোমার জ্বর কি বেড়েছে?
তাই মনে হচ্ছে।
মাথায় পানি ঢালতে হবে?
না। তুমি বসে আছ কেন? খেতে যাও।
তিতলী চলে গেল। শওকত ভেবেছিল তিতলী গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখবে। এই ভদ্রতা সাধারণ ভদ্রতা। তিতলীর কাছ থেকে এই সামান্য ভদ্রতাটুকু কি আশা করা যায় না?
নতুন জায়গায় তিতলীর ঘুম হয় না। নগরকেটের হোটেলে তার খুব ভালো ঘুম হলো। দীর্ঘ ঘুম এবং খুব আরামের ঘুম। ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। হোটেলের ভেতরে তখনো অন্ধকার। শওকত চাদর মুড়ি দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। তার মাথা বালিশ থেকে সরে গেছে। বাচ্চাদের এই অভ্যাস শওকতের আছে। মাথার নিচে বালিশ থাকে না। তিতলীর একবার ইচ্ছা করল শওকতের মাথাটা বালিশে তুলে দেয়। তারপরই মনে হলো থাক।
সে বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধোল। কলটা ছাড়ল খুব সাবধানে। অসুস্থ মানুষ-ঘুম যেন না ভাঙে।
তিতলী ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় এল। সেখান থেকে চলে এল হোটেলের বাগানে। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। যে বিস্ময়কর দৃশ্য তার সামনে ছিল তার জন্যে তার কোনো প্ৰস্তুতি ছিল না। দিগন্তজুড়ে হিমালয় পর্বতমালা। বরফের চাদরে তার গা ঢাকা। প্ৰভাতের প্রথম সূর্যকিরণে সেই চাদরে সোনালি আভা লাগতে শুরু করেছে। এ কী অপরূপ দৃশ্য! তিতলী মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগোচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘন কুয়াশা তাকে ঢেকে ফেলল। বর্ষাকালে এত কুয়াশা এল কোথেকে? হঠাৎ তার মনে হল–এটা মেঘ না তো? জলভরা একখণ্ড মেঘ কি তাকে জড়িয়ে ধরেছে? অবশ্যই তাই। এম্বেসির সোবাহান সাহেব এ জাতীয় কথাই তো বলেছিলেন। নগরকোট এত উঁচুতে যে গায়ের ওপর দিয়ে মেঘ চলে যায়। হাতের মুঠোয় মেঘ ধরা যায়; এই তো সেই মেঘ। আকাশের মেঘ হাত দিয়ে ছোয়া যাচ্ছে! চোখের সামনে হিমালয়ের রঙ বদলে যাচ্ছেপ্রকৃতি এত সুন্দর হয়? তিতলীর রীতিমতো কান্না পেয়ে গেল। এত সুন্দর কখনো একা দেখা যায় না। শওকতকে এনে দেখাতে হবে। ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে আসতে হবে। বাগানে চেয়ার-টেবিল পাতা আছে। হোটেলের গেস্টরা চেয়ারে বসে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের সামনে পটভর্তি চা। তিতলীরাও তাই করবে। দুজন বসে চা খাবে তারপর হঠাৎ একসময় বিশাল একখণ্ড মেঘের ভেতর তারা ডুবে যাবে।