শওকত বড় একটা পেপার গ্লাস নিয়ে তিতলীর দিকে আসছে। তার ভুরু কুঁচকে আছে। চিন্তা মনে হয় আরো বেড়েছে।
তিতলী নাও পেপসি খাও।
তিতলী গ্লাস হাতে নিল। তার পেপসি খেতে ইচ্ছে করছে না–মানুষটা এত আগ্ৰহ করে এনেছে, না খেলে ভালো দেখায় না। একবারের জন্য হলেও গ্লাসটা ঠোঁট ছোঁয়ানো দরকার। তারপর হাতে নিয়ে বসে থাকলেই হবে।
তিতলী বলল, কোনো সমস্যা হয়েছে?
না। তেমন কিছু না। আমার সুটকেসটা আসে নি। ওরা বলছে এক ঘণ্টা পর রয়েল নেপাল এয়ারলাইনসের একটা প্লেন আসবে। সুটকেসটা নাকি সেখানে। অপেক্ষা করা ছাড়া পথ দেখছি না। তোমার বোধহয় চুপচাপ বসে থাকতে খারাপ লাগছে।
খারাপ লাগছে না। তোমার গাল ফোলা। কী হয়েছে?
হঠাৎ করে দাঁত ব্যথা শুরু হয়েছে।
বেশি?
হাঁ বেশি। হোটেলে গিয়ে পেইনকিলার টিলার খেতে হবে।
আমার কাছে প্যারাসিটামল আছে।
প্যারাসিটামলের স্টেজ পার হয়ে গেছে। তুমি বস, আমি হোটেলের খোঁজ নিই। গল্পের বইটই কিছু এনেছ? বসে বসে পড়।
গল্পের বই লাগবে না।
শওকত চিন্তিতমুখে হোটেল ইনকোয়োরির দিকে যাচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে তাকে নিয়ে যাবার জন্যে বাংলাদেশ এম্বেসির এক ভদ্রলোকের আসার কথা। হোটেল বুকিং তারই করে রাখার কথা। তিনি আসেন নি। এম্বেসিতে টেলিফোন করেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। চারটা বাজে। অফিস আওয়ার্স শেষ। হোটেল রিজার্ভেশনের সমস্যা হয়তো হবে না। এখন টুরিস্ট সিজন না। ভরা বর্ষায় কেউ নেপাল বেড়াতে আসে না। হোটেলের চেয়েও বেশি জরুরি–একজন ডাক্তার খুঁজে পাওয়া। দাঁতের ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। মাথা দপদপ করছে। নেপাল এয়ারলাইনসে সুটকেস পাওয়া না গেলে রেডিমেড শার্ট-প্যান্ট থেকে শুরু করে টুথপেস্ট, টুথব্রাশ সবই কিনতে হবে।
নেপাল এয়ারলাইনসের ফ্লাইট দু ঘণ্টা দেরি করে এল। সেখানে সুটকেস নেই। শওকতের গাল আরো ফুলেছে। মনে হচ্ছে জ্বর এসে গেছে। বাইরে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। মুষলধারে বৃষ্টি। পাহাড়ি অঞ্চল বলেই কি বৃষ্টির ফোঁটা এত বড়?
এম্বেসির ভদ্রলোকের নাম সোবহান। তিনি শেষ পর্যন্ত এসেছেন। ভদ্রলোক বিমানের টাইমিঙে গণ্ডগোল করেছেন। তবে ভদ্রলোক করিতককর্মা। নগরকেটে হোটেল বুকিং নিয়ে রেখেছেন। কাঠমাণ্ডুতে নাকি দেখার কিছু নেই। ভদ্রলোকের মতে হিমালয়ের সঙ্গে প্ৰথম পরিচয় নগরকেটে হওয়া উচিত। ভদ্রলোক এয়ারপোর্ট থেকেই শওকতের সুটকেস খুঁজে বের করলেন। পরের দিন বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে সুটকেস আসবে এটা নিশ্চিত করলেন। ডেনটিক্টের সঙ্গেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলেন। বিদেশের এম্বেসিতে যারা কাজ করেন তারা ঘুমানো এবং শপিং করা ছাড়া অন্য কিছুই পারেন না বলে যে ধারণা দেশে প্রচলিত তা সম্ভবত সত্যি নয়।
ভদ্রলোক শওকতকে শার্ট-প্যান্ট কিনতে দিলেন না। গষ্ঠীরমুখে বললেন, কাল তো সুটকেস চলেই আসছে–শুধু শুধু ডলার খরচ করবেন কেন? একটা রাতেরই তো কারবার। ভাবির শাড়ি প্যাঁচ দিয়ে লুঙ্গির মতো পরে শুয়ে থাকবেন। দুপুরের মধ্যে আমি সুটকেস পৌঁছে দেব। পরদিন রওনা করবেন পোখরা।
শওকত বলল, কোথায় যাব?
পোখরা। সেখানে খুব সুন্দর তিনটা হ্রদ আছে–ফিওয়া, বেগনাস এবং রুপা। লোকগুলোর উৎস হলো অন্নপূর্ণ রেঞ্জের তুষার গলা পানি। ফিওয়া হ্রদের পাশে লোকভিউ হোটেল। একটা রুমি নিয়ে রেখেছি। এসি রুম, আপনাদের পছন্দ হবে।
যাব। কীভাবে?
বাইরোডে যাবেন। ট্যাক্সি নিয়ে যাবেন। প্লেনেও যাওয়া যায়। ওয়ান ওয়ে টিকিট ফোর্টি নাইন ডলার। প্লেনে যাওয়া অর্থহীন। পোখরা যাবার দুপাশের দৃশ্য না দেখলে মানবজন্ম বৃথা।
কাঠমাণ্ডুতে কিছু দেখার নেই?
মন্দির ফন্দির আছ–চাইলে একদিন দেখিয়ে আনব। ইউরোপ আমেরিকার টুরিস্টরা ক্যামেরা হাতে নিয়ে খুব আগ্রহ করে পটাপট মন্দিরের ছবি তোলে। মন্দির দেখার জন্যে নেপালে আসার দরকার কী? নেপালে এসেছেন। হিমালয় দেখবেন। প্রাণভরে হিমালয় দেখুন। তবে…।
তবে কী?
বর্ষাকাল তো। হিমালয় দেখতে পারবেন কি না, সেটা হলো কথা। আকাশ পরিষ্কার না থাকলে কিছু দেখা যায় না। আপনাদের ভাগ্য ভালো হলে ইনশাল্লাহ দেখবেন।
তারা নগরকেটে পৌঁছল রাত আটটার দিকে। বৃষ্টি তখনো ঝরছে। মুষলধারে না হলেও ঝিরবির করে পড়ছে। আঁকাবাকা পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তায় আলো নেই। একপাশে গভীর গিরিখাদ। স্টিয়ারিঙের হতে শক্ত না হলে ভয়াবহ অ্যাকসিডেন্ট ঘটবে। বষ্টিভেজা রাস্তাও খুব পিছল। মাঝে মাঝেই গাড়ি ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে যাচ্ছে। অল্পবয়সী ড্রাইভার জয় পশুপতিনাথজী বলে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে।
শওকত বলল, রাস্তা তো ভয়াবহ। তিতালী তোমার ভয় লাগছে?
তিতলী বলল, না।
তাহলে তোমাকে ‘সাহসী তরুণী’ টাইটেল দেয়া যায়। ভয়ের চোটে আমার দাঁত ব্যথা সাময়িকভাবে চলে গেছে। আমার ধারণা হোটেলে পৌঁছার পর ভয় কেটে যাবে, দাঁত ব্যথা আবার শুরু হবে।
সেক্ষেত্রে হোটেলে না পৌঁছে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো ভালো।
শওকত শব্দ করে হাসল। তিতালীর মনে হল–মানুষটার হাসি খুব সুন্দর। হাসান ভাইয়ের হাসিও সুন্দর, তবে হাসান ভাই এত শব্দ করে হাসত না। তিতালীর অস্বস্তি লাগছে। তুলনামূলক চিন্তা সে কেন করছে। এর মধ্যে তুলনার কী আছে?
বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়ি থেমেছে। ড্রাইভার জয় জয় পশুপতিনাথজী বলে দু’হাত একত্র করে স্টিয়ারিংকে নমস্কারের মতো করেছে। তিতালী ভীত গলায় বলল, কী হয়েছে? ড্রাইভার হাসিমুখে বলল, বহেনজি আ গয়া।