সবাই জানবে একটা ছেলে ছিল, হারিয়ে গেছে। কত মানুষ তো হারিয়ে যায়।
তা যায়।
আমার ভাইয়ের কি জানাজা হবে? কবর হবে?
হ্যাঁ হবে। আপনি কাঁদবেন না।
ওসি সাহেব আপনার নামটা কি জানতে পারি?
কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে আমার নামও রকিব। হাসান সাহেব কাঁদবেন না প্লিজ। আর ভাই শুনুন–আই অ্যাম সরি।
জ্বরে হাসানের গা পুড়ে যাচ্ছে।
বাড়িতে কেউ নেই। তারেক গিয়েছে চিটাগাং। রীনা এসে টগর-পলাশকে নিয়ে গেছে। লায়লা তার শ্বশুরবাড়িতে। হাসানের মা তার বড় মেয়ের বাড়িতে। শুধু হাসানের বাবা আশরাফুজ্জামান সাহেব আছেন। তবে এই মুহুর্তে তিনি বাড়িতে নেই। চায়ের স্টলে বসে আছেন। গরম গরম জিলাপি ভাজা হচ্ছে। তিনি জিলাপি খাচ্ছেন। রসে তার মুখ মাখামাখি। এত ভালো জিলাপি তিনি অনেক দিন পর খাচ্ছেন। মাখনের মতো মোলায়েম হয়েছে। মুখে দেয়ামাত্র গলে যাচ্ছে।
কমলার মা গোঙানির শব্দ শুনে হাসানের দরজার সামানে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ভীত গলায় ডাকল, ভাইজান?
হাসান চোখ মেলল। তার চোখ টকটকে লাল। হাসান ভারি গলায় বলল, কে?
কমলার মা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ভাইজান আমি।
হাসান আবারো বলল, কে?
ভাইজান আমি কমলার মা। আপনের কী হইছে ভাইজান?
মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে কমলার মা।
খুব বেশি?
হ্যাঁ খুব বেশি।
হাসান চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে জেগে আছে অথচ সেই বিশ্ৰী স্বপ্নটা আবার শুরু হয়েছে। একদল হাঁস যাচ্ছে। সে হাঁটছে। হাঁসের সঙ্গে। হাঁসিরা শামুক গুগলি জাতীয় খাবার খাচ্ছে। ঝিনুকের খোল খুলতে তার কষ্ট হচ্ছে। একটা হাঁস তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। হাঁসটার চোখ মানুষের চোখের মতো বড় বড়।
জেগে থেকেই সে এই স্বপ্নটা দেখছে কেন? তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? এই দুঃস্বপ্নের কথা সে তিতলী ছাড়া আর কাউকে বলে নি।
স্বপ্নের কথা শুনে তিতলী বলেছিল। খিচুড়ি দিয়ে ভূনা হাঁসের মাংস খেলে তোমার হাঁসের স্বপ্ন দেখার এই রোগ সেরে যাবে। শীতকাল আসুক আমি নিজে তোমাকে ভুনা হাঁসের মাংস খাওয়াব। তুমি কি জান আমি খুব ভালো রাধুনি?
না জানি না।
আমার অনেক কিছুই তুমি জান না। একেক করে জানবে। আর মুগ্ধ হবে। এই পৃথিবীতে মটরশুঁটি দিয়ে কই মাছের ঝোল আমার চেয়ে ভালো কেউ রাঁধতে পারে না। শীতকাল আসুক তোমাকে মটরশুঁটি আর কই মাছের ঝোল খাওয়াব।
আচ্ছা।
মাছের ঝোল রান্নার গোপন কৌশল কি তুমি জান?
জানি না।
জানতে চাও?
না।
জানতে না চাইলেও বলব। মাছের ঝোল রান্নার আসল কৌশল হলো–অনেকক্ষণ নাড়াতে নাড়তে হাত ব্যথা হয়ে যাবে। তবু চামচ নাড়ানো বন্ধ করবে না। বুঝেছ?
হুঁ।
শীতকাল আসতে কত দেরি? এখন কোন কাল? বর্ষা শেষ হয়ে গেছে না?
হাসান চোখ মেলল।
কমলার মা বলল, ভাইজান মাথাত পানি ঢালমু?
হাসান বলল, না।
যন্ত্রণা কি আরো বাড়ছে ভাইজান?
হুঁ।
মাথা বিষের বড়ি খাইবেন?
না। তুমি এখন যাও।
হাসান চোখ বন্ধ করছে না। চোখ বন্ধ করলেই হাঁসের পাল চলে আসবে। চুড়ির শব্দ হচ্ছে। কে এসেছে চুড়ি পরে? তিতলী না তো? হাসান জানে কেউ নেই তারপরেও বলল, কে তিতলী! আশ্চর্য ব্যাপার। মাথার ভেতরে তিতলী কথা বলে উঠল।
হুঁ।
কেমন আছ?
ভালো।
তোমাকে অনেক দিন থেকে মনে মনে খুঁজছি।
কেন?
ওই যে একটা গান করেছিলে বুড়িগঙ্গায় ওই গানের লাইনগুলো কী?
আমি তো গান করি নি।
তিতলী শোন!
শুনছি।
আমি খুব একটা অন্যায় করেছি। তোমাকে বলা হয় নি।
বল।
নাদিয়া এত ভালো রেজাল্ট করেছে, ওকে কনগ্রাচুলেশনস জানানো হয় নি। আমি ওর জন্যে একটা গিফট কিনে রেখেছিলাম। সেই গিফটটাও তাকে দেয়া হয় নি।
একদিন বাসায় গিয়ে ওকে দিয়ে এসো।
তুমি রাগ করবে না তো?
আমি রাগ করব কেন?
তিতলী!
বল শুনছি।
হাঁসের স্বপ্নটা আমি এখনো দেখি।
ও আচ্ছা।
স্বপ্নটা দেখার সময় মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়।
ও আচ্ছা।
তিতলী আমার মনটা সারাক্ষণ খুব খারাপ থাকে।
ও আচ্ছা।
তুমি কি জান আমি এখানে, মাঝে মাঝে তোমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি?
ও আচ্ছা।
কয়েকদিন আগে তোমাদের কলেজে গিয়েছিলাম। মনের ভুলে চলে গিয়েছি।
ও আচ্ছা।
এখন আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।
ও আচ্ছা।
আশরাফুজ্জামান বাড়িতে ফিরলেন রাত ন’টায়। তিনি ছেলেকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কী হয়েছে হাসানের? তিনি ভীত গলায় বললেন, তোর কী হয়েছে রে? তোর চোখ এত লাল কেন?
হাসান লাল চোখে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না।
তিতলী লক্ষ্য করল
তিতলী লক্ষ্য করল শওকতের বাঁ গাল খানিকটা ফোলা। সে কিছুক্ষণ পরপর গালে হাত দিচ্ছে। তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। বেশি রকম চিন্তিত হলে শওকত মাথার চুল টানে। এখন মাথার চুলও টানছে। চুল এলোমেলো হয়ে আছে। চিন্তিত হাবার মতো কোনো কারণ ঘটেছে? পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে। ট্রাভেলার্স চেকভর্তি মানিব্যাগ খোয়া গেছে? তিতলী বসে আছে। কাঠমুণ্ডু এয়ারপোর্টে সে কৌতুহল নিয়ে শওকতকে লক্ষ করছে। সমস্যায় সে যে পড়েছে তা তাকে দেখে বোঝা যায়। মানুষটার একটা বড় গুণ হচ্ছে যত সমস্যাতেই পড়ুক সোধৈৰ্য হারায় না। খুব বেশি হলে মাথার চুল টানে। চুল টানারও কি কোনো বিশেষ ভঙ্গি আছে? টেনশন বেশি হলে মাথার সামনের চুল টানা। টেনশন কম হলে পেছনের চুল টানা জাতীয় কিছু। তিতলী এমনভাবে মানুষটাকে লক্ষ করে নি। প্রয়োজন বোধ করে নি। এখনো প্রয়োজন বোধ করছে না।