দেখতে হবে না। স্যার। আপনি যখন বলছেন তখন অবশ্যই আছে।
তবুও তুমি একবার দেখে নাও।
হাসান মানিব্যাগ বের করে দেখল। হিশামুদিন সাহেব বললেন, নোটের গায়ে কী ছবি আঁকা থাকে তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। তারপরেও আমি মনে করি–আমাদের দৃষ্টি আরো পরিষ্কার থাকা দরকার। মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে এই কথাটা তোমাকে বললাম। কেন বললাম বল তো?
বলতে পারছি না। স্যার। আমার বুদ্ধি সাধারণ মানের।
আজ এই পৰ্যন্তই থাক।
জ্বি আচ্ছা।
হিশামুদ্দিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। হাসান খুবই অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। না সে রকম কোনো ঘটনা ঘটে নি–লুঙ্গি গড়িয়ে নিচে নেমে যায় নি। হিশামুদিন সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কাঁটায় কাঁটায় চারটা বাজছে। হিশামুদিন সাহেব চারটা থেকে সাড়ে চারটা এই ত্রিশ মিনিট তাঁর শোবার ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। নিজের ইচ্ছায় না, ডাক্তারের নির্দেশে। দুটা বড় ধরনের স্ট্রোক তার হয়ে গেছে। তৃতীয়টির জন্যে অপেক্ষা। অপেক্ষার সময়টায় নানান নিয়মকানুন মেনে চলা। আজ হিশামুদিন সাহেব নিয়মের খানিকটা ব্যতিক্রম করলেন। শোবার ঘরে ঢোকার আগে মতিঝিলে হিশামুদিন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের হেড অফিসে টেলিফোন করলেন। টেলিফোন ধরল জীবন। জীবনকে তিনি একটা কাজ দিয়েছিলেন। হাসান সম্পর্কে খোঁজখবর করা। ছেলেটি সম্পর্কে কৌতুহল বোধ করছেন বলেই অনুসন্ধান।
আজ হাসানের একটা ব্যাপার তাঁর চোখে পড়েছে। তিনি যখন বলছিলেন–সিলিং থেকে ফ্যান খোলা হচ্ছে আর তাঁর বাবা দূরে দাঁড়িয়ে অমায়িক ভঙ্গিতে হাসছেন–তখনই তিনি লক্ষ করলেন হাসানের চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখের পানি সামলাবার জন্যে দ্রুত অন্যদিকে তাকিয়েছে। হিশামুদিন সাহেবের অনেক প্রিয় গল্পের মধ্যে এই গল্পটি একটি। অনেককে এই গল্প বলেছেন। সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনেছে। কারো চোখে পানি আসে নি। শুধু তাঁর মেয়ে চিত্ৰলেখার চোখে পানি এসেছিল। তাঁর মেয়েটি সেদিন স্কুল থেকে জ্বর নিয়ে ফিরছে। চোখ লাল। নাক দিয়ে ক্রমাগত পানি করছে। জ্বরে কাতর মেয়েটিকে দেখে তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। রাত ন’টায় তিনি রওনা হবেন জাপানে। এয়ারপোর্টে সন্ধ্যা সাতটায় রিপোটিং। মেয়েটিকে একা রেখে তাকে যেতে হবে। বিশাল এই বাড়িতে চিত্ৰলেখা একা একা ঘুরবে। তিনি এয়ারপোর্টে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে মেয়ের পাশে বসলেন। না, জ্বর বেশি না। উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। চিত্ৰলেখা বলল, তোমার এয়ারপোর্ট যাবার সময় হয়ে গেছে। তাই না বাবা? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
কতক্ষণ থাকতে পারবে। আমার পাশে?
আধঘণ্টা।
তাহলে একটা গল্প বল।
তিনি তাঁর বাবার ফ্যানের গল্পটা বললেন। গল্পের এক পর্যায়ে চিত্ৰলেখা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তিনি সহজ গলায় বললেন, কাঁদছ কেন মা?
তোমার বাবার কথা মনে করে কান্না পাচ্ছে।
ও আচ্ছা।
তোমার বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন। তাই না? এখন তোমার কত টাকা! ইচ্ছে করলে বাংলাদেশের সব ফ্যান তুমি কিনে নিতে পার তাই না বাবা?
হুঁ।
তোমার বাবা তোমার ভাইবোনদের মধ্যে কাকে সবচে’ ভালোবাসতেন?
আমার বড় বোনকে, তাঁর নাম পুষ্প।
তাকে সবচে’ ভালবাসতেন কেন?
বড়বুবু দেখতে অবিকল আমার মা’র মতো ছিলো, এই জন্যেই বোধহয়। তাছাড়া প্ৰথম সন্তানের প্রতি বাবা-মা’র একটা আলাদা মমতা থাকে।
তোমাকে কতটা ভালবাসতেন?
আমাকে খুব সামান্য। আমি সবার শেষের দিকে তো এই জন্যে বোধহয়। মাঝে মাঝে আমার নাম পর্যন্ত ভুলে যেতেন।
কী যে তুমি বল বাবা নাম ভুলবে। কী করে?
ভুলে যেতেন। আমার ঠিক আগের ভাইটার নাম ফজলু। আমার ডাকনাম বজলু। তিনি আমাকে ডাকতেন ফজলু বলে।
তুমি রাগ করতে না?
না।
আমি হলে খুব রাগ করতাম। আমাদের অঙ্ক আপা আমাকে মাঝে মাঝে ডাকেন চিত্ররেখা। আমি জবাব দিই না। চিত্ররেখা তো আমার নাম না। চিত্ররেখা ডাকলে আমি কেন জবাব দেব? ঠিক না বাবা?
হ্যাঁ ঠিক।
এখন তোমার এয়ারপোর্টে যাবার সময় হয়ে গেছে তুমি চলে যাও।
তোমার জন্যে কিছু আনতে হবে?
না।
কিছু না?
না, কিচ্ছু না।
হিশামুদ্দিন সাহেব তাঁর বাবার গল্প যখন বলছিলেন তখন ঠিক যে জায়গায় এসে চিত্ৰলেখা কেঁদে ফেলেছিল। সেই জায়গায় হাসান ছেলেটার চোখে পানি এসেছে। ব্যাপারটা তুচ্ছ, আবার ঠিক তুচ্ছও না। জীবনকে এই ছেলেটি সম্পর্কে খোঁজখবর করতে বলেছিলেন। সে কতটা খোঁজখবর করেছে কে জানে!
হ্যালো জীবন?
জ্বি স্যার।
হাসান ছেলেটি সম্পর্কে তোমাকে খোঁজ নিতে বলেছিলাম–খোঁজ নিয়েছ?
জ্বি স্যার। খুবই সাধারণ ছেলে স্যার।
এ ছাড়া আর কী?
ঝিকাতলায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকে। এড্রেস হচ্ছে এগার বাই…
হিশামুদ্দিন বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকালেন। হড়বড় করে এড্রেস বলছে–এড্রেস তো তার অফিসেই আছে। জীবন এখন পর্যন্ত কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারে নি। ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না। তবু এই ছেলেটিকে তাঁর বেশ পছন্দ।
হাসান সম্পর্কে আর কী জান?
কয়েকটা প্ৰাইভেট টিউশ্যানি করে?
কটা?
একজক্ট বলতে পারছি না। স্যার।
বিয়ে করেছে?
জ্বি না।
তার কোনো পছন্দের মেয়ে কি আছে?
জ্বি স্যার, একজনের বাসায় মাঝে মাঝে যায়–সেই বাসার এড্রেস হলো স্যার—কলাবাগান—ভেতরের দিকে দুই বাই…
হিশামুদ্দিন আবারো ভুরু কুঁচকালেন। জীবন মনে হয় এড্রেস ছাড়া আর কিছু বলতে পারবে না। সে এড্রেস-বিশেষজ্ঞ।